১২ বছর ধরে কোচের চাকরি চেয়েও পাচ্ছেন না রফিক

বিশেষ সংবাদদাতা
বিশেষ সংবাদদাতা বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০১:০৭ পিএম, ০৬ জুন ২০২০

তার অর্জন-কীর্তির কথা বলে শেষ করা যাবে না। বাংলাদেশের ক্রিকেটের রুপকথার নায়ক তিনি। কারও কারও চোখে মোহাম্মদ রফিক হলেন এ দেশের ক্রিকেটের ‘হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা।’ মোহাম্মদ আশরাফুল যদি হন প্রথম আন্তর্জাতিক তারকা, তাহলে মোহম্মদ রফিক অতি অবশ্যই বাংলাদেশের ক্রিকেটের প্রথম আলোচিত চরিত্র।

তার ক্রিকেটার হবার গল্পটাই অন্যদের চেয়ে ভিন্ন। সেই বুড়িগঙ্গার ওপারে কেরানীগঞ্জের এক অজপাড়া গ্রামে বেড়ে ওঠা। প্রতিদিন নৌকায় করে শ্যামবাজার ঘাট দিয়ে এপারে আসা। তারপর নিজেকে গড়ার অদম্য স্পৃহা। প্রাণপন চেষ্টায় বাঁহাতি পেসার থেকে স্পিনার হয়ে ওঠা।

গেন্ডারিয়া ক্রিকেটার্সের হয়ে দ্বিতীয় বিভাগ ওরিয়েন্টের পক্ষে প্রথম বিভাগ খেলে অনেক চরাই উৎরাই পার হয়ে কঠিন লড়াই-সংগ্রামের পর ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটের বড় দল বিমানে নাম লেখানো। সেখান থেকে আরেক বড় দল মোহামেডানে যোগ দেয়া। তার পরপরই আন্তজাতিক ক্রিকেটার হিসেবে যাত্রা শুরু এবং নিজেকে মেলে ধরা, ৯৭’র আইসিসি ট্রফি বিজয়ের অন্যতম রুপকার হওয়া।

১৯৯৮ সালে কেনিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে জয়ের নায়ক। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে প্রথম টেস্ট জয়েরও অন্যতম রুপকার। প্রথম ইনিংসে ৫ উইকেট শিকারি।দেশের বোলারদের ভিতরে সবার আগে টেস্ট-ওয়ানডেতে ১০০ উইকেট শিকারিও তিনি। সব মিলে একজন আদর্শ বাঁহাতি অর্থোডক্স স্পিনার মোহাম্মদ রফিক।

শুধু স্পিনার বলা ঠিক হবে না। বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে জয়ের নায়ক রফিক ব্যাট হাতে প্রতিপক্ষ বোলারদের শাসন করে ৭৭ রানের দারুণ ইনিংস উপহার দিয়ে হয়েছেন ম্যাচ সেরা। নিচের দিকে নেমে নিয়মিত বড় শট খেলার সামর্থ্য ছিল তার। সবসময়ই মেরে খেলতে পারতেন। যেটা এখনও বাংলাদেশের নিচের ব্যাটসম্যানদের বড় সমস্যা। রফিক সেখানে ছিলেন সাহসী যোদ্ধা। উইলোর দাপটে চার-ছক্কা হাঁকাতে পারতেন অবলীলায়। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট শতকের অসামান্য কৃতিত্বও আছে তার।

সব মিলে এক বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার। সফল ক্রিকেটারের মূর্ত প্রতীক রফিক। অর্জন-কৃতিত্ব ধরলে অবশ্যই এগিয়ে সাকিব আল হাসান। তবে দেশ-বিদেশে অনেক বোদ্ধা-বিশেষজ্ঞর চোখে রফিকই বাংলাদেশের সব সময়ের সেরা বাঁহাতি স্পিনার। ন্যাচারাল ট্যালেন্ট বলতে যা বোঝায় রফিক ছিলেন তাই।

অনেকেরই ধারণা, বাংলাদেশে তরুণ প্রজন্মের আদর্শ হতে পারেন রফিক। বিশেষ করে যারা স্পিন বোলিং করেন, তাদের আদর্শ গুরু ও মেন্টর হওয়ার সব যোগ্যতাই আছে রফিকের। তাকে জাতীয় দল, এইচপি কিংবা অনূর্ধ্ব-১৯ দলের স্পিন বোলিং কোচের দায়িত্ব দিলে স্পিনারদের উন্নতিটা আরও দ্রুত হতো- এমন বিশ্বাস অনেকের।

অনেক বেশি অর্থ দিয়ে ভিনদেশি কোচ, স্পিন উপদেষ্টা নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু বেশিরভাগের আউটপুট নেই। সবচেয়ে বড় কথা তাদের ইংরেজি একসেন্ট দেশের তরুণ প্রজন্ম আত্মস্থ করতে পারছেন কি না?- তা খুঁটিয়েও দেখা হয় না।

সেখানে রফিক নিজেদের মাতৃভাষায় তরুণদের স্পিনের নানা কারুকাজ শেখাতে পারেন। প্রয়োজনীয় বুদ্ধি পরামর্শ দিতে পারেন এবং নিজের খেলোয়াড়ি জীবনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে নাঈম হাসান, মেহেদি হাসান মিরাজ, সানজামুল ইসলাম ও নাজমুল অপুদের আরও উন্নত করার মত মেধা-প্রজ্ঞা আছে তার। কিন্তু দেশের স্পিনের সেই রত্ন-রফিক কোথাও নেই।

খেলোয়াড়ি জীবন শেষে রফিক যে ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন, তা আজ পর্যন্ত পূরণ হয়নি। রফিক অবসরের সময় বলেছিলেন, আমি মাঠের মানুষ, মাঠেই থাকতে চাই। কোচিং থেকে শুরু করে না হয় কিউরেটরের কাজ করে হলেও ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িয়ে থাকার ইচ্ছে রাখি। কিন্তু তার সে আশা পূরণ হয়নি। আজ পর্যন্ত বিসিবির বেতনভুক্ত কোচ হতে পারেননি রফিক।

এ দেশবরেন্য ও আন্তর্জাতিক মানের বাঁহাতি স্পিনারের এখনও রয়ে গেছে সেই আক্ষেপ। শুক্রবার রাতে নটআউট নোমানের ইউটিউব লাইভে তিনি বলেছেন, ‘কত বছর ধরে ক্রিকেট থেকে রিটায়ার্ড করেছি। কিন্তু ক্রিকেটে কোন জব করতে পারছি না। অনেকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কতজনকে বলছি, রিকুয়েস্ট করেছি। কিন্তু কেউ আমাকে কোন কাজ দেয়নি। আশ্বাস দিয়ে বলেছে, ঠিক আছে আমরা ব্যস্ত আছি। পরে বলবো, পরে বলবো- পরে বলতে বলতে তো ১২ বছর চলে গেলো। শেষপর্যন্ত আমার আর ক্রিকেট বোর্ডে কোন কোচের চাকরি হয়নি।’

‘আমি তো আর কারো দান-দয়া চাচ্ছি না। আল্লাহর রহমতে শরীর সুস্থ আছে। আমি এখনও ফিট আছি। আল্লাহর রহমতে শরীরে শক্তি আছে। আমি বিশ্বাস করি ক্রিকেটের জন্য কাজ করেই উপার্জন করতে পারব এবং আমি কোন আকাশ ছোঁয়া ডিমান্ডও নেই আমার। আমার কাজ অনুপাতেই যেন অর্থ দেয়া হয় আমাকে।’

রফিকের শেষ কথা, ‘আমরা কিন্তু অবসরের পর মনে হয় সেই ওসমান ভাইয়ের অবস্থায়ই আছি। আমাদেরও কোন কদর নেই। যথাযথ মূল্যায়নের অভাব। আজকে দেখেন, কত বছর ধরে অবসর নেয়ার পরও বোর্ডের কোন কোচের চাকরি পাইনি। দেখা যাচ্ছে, ওসমান ভাই-আলতাফ ভাইদের (দেশের সাবেক কোচ) জীবনের মতই আমাদের অবস্থা হয়েছে।’

এআরবি/এসএএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।