শিরিনের ১২ বারের রেকর্ড ভাঙতে চান ১৭ বছরের সুমাইয়া
মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার গড়পাড়ার আলীনগর গ্রামের তজুমদ্দিন দেওয়ান অনেক স্বপ্ন দেখতেন তার তিন মেয়ের মধ্যে বড় সুমাইয়া দেওয়ানকে নিয়ে। নিজে ফুটবল খেলতেন। মেয়েকে নিয়ে স্বপ্ন ছিল ট্র্যাকে দেশের সেরা হবে।
দেশ ও দেশের বাইরে ট্র্যাকে দৌড়ে সুনাম অর্জন করবে তার মেয়ে। সুমাইয়া পেরেছেন। কিন্তু সেটা দেখে যেতে পারেননি তজুমদ্দিন। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মেয়ের সাফল্য না দেখেই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছেন দুই বছর আগে।
এ বছর জানুয়ারিতে বাংলাদেশ আর্মি স্টেডিয়াম জাতীয় অ্যাথলেটিকসে মেয়েদের ১০০ মিটার স্প্রিন্টে ১২ বারের চ্যাম্পিয়ন শিরিন আক্তারকে হারিয়ে হয়েছেন দেশের দ্রুততম মানবী। আনন্দের ওই দিনে সুমাইয়ার চোখে ছিল পানি। বারবার তার বাবার কথা মনে হয়েছে- তিনি থাকলে যে সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন।
ঘরোয়া অ্যাথলেটিকসে মেয়েদের ১০০ মিটারে অপ্রতিরোধ্য হয়েছিলেন শিরিন আক্তার। সাতক্ষীরার শিরিন একটানা ১২ বার সেরা হয়েছিলেন ১০০ মিটার স্প্রিন্টে। শেষ পর্যন্ত তিনি থেমেছেন মানিকগঞ্জের সুমাইয়ার কাছে। শিরিনের হাত থেকে যে স্বর্ণ ছিনিয়ে নিয়েছেন সেটা সহসা ফেরত দিতে চান না ১৭ বছরে দেশের দ্রুততম মানবী হওয়া সুমাইয়া।
দুজনেরই বিকেএসপিতে গড়ে ওঠা। শিরিন এখন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অ্যাথলেট, সুমাইয়া বিকেএসপিতে উচ্চ মাধ্যমিকের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। প্রথমবার জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়েই সুমাইয়া হারিয়ে দিয়েছেন ১০ বছরের সিনিয়র শিরিন আক্তারকে।

শ্রেষ্ঠত্বের যে মুকুট পরেছেন সুমাইয়া তা মাথায় রাখতে চান দীর্ঘ সময়। ‘আমার এখন একটাই লক্ষ্য শিরিন আপুর ১২ বার দ্রুততম মানবীর রেকর্ড ভাঙা। আমি তার চেয়ে বেশিবার দেশের দ্রুততম মানবী হতে চাই’ - বলছিলেন সুমাইয়া দেওয়ান। এ জন্য তিনি ধীরে ধীরে নিজেকে আরও পরিপূর্ণভাবে তৈরি করতে চান।
১২.৩২ সেকেন্ডে সুমাইয়া দেশের দ্রুততম মানবী হয়েছেন। শিরিন দ্বিতীয় হয়েছেন তার চেয়ে ০০.০৪ সেকেন্ড সময় বেশি নিয়ে। পার্থক্য খুবই কম। শিরিন এই পার্থক্যটা কমিয়ে আবার ফিরে পেতে চান তার হারানো মুকুট।
তো সুমাইয় যে চ্যালেঞ্জটা ছুড়ে দিয়েছেন শিরিন আক্তারকে সেটাকে কীভাবে দেখছেন একটানা ১২ বার দ্রুততম মানবী? ‘এটা অত্যন্ত ভাল খবর যে, সুমাইয়া আমাকে ছাড়িয়ে যেতে চায়। আমিও চাই আমার শ্রেষ্ঠত্ব ফিরে পেতে। ওর চ্যালেঞ্জটা অ্যাথলেটিকসের জন্যই ভালো। দুজনই দ্রুততম মানবী হতে চাইলে দুজনের আরও ভালো করতে হবে’ - বলছিলেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অ্যাথলেট শিরিন।
স্কুলে পড়া অবস্থায়ই সুমাইয়া ছিলেন অ্যাথলেটিকসে সেরা। মানিকগঞ্জের গড়পাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় তিনি দৌড়, উচ্চলম্ফ, দীর্ঘলম্ফ ইভেন্টে ছিলেন সেরা। ওই শ্রেষ্ঠত্বই তাকে ওপরে উঠতে সহায়তা করে। ২০১৭ সালে মানিকগঞ্জে বিকেএসপির যে ট্রায়াল হয় সেখানে অংশ নেন সুমাইয়া এবং সুযোগ পেয়ে যান দেশের একমাত্র ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার।
ভর্তি হন সপ্তম শ্রেণিতে। বিকেএসপির হয়ে নেপালে অংশ নিয়েছিলেন ইয়ুথ অ্যাথলেটিকসে। স্বর্ণ জিতে জানান দিয়েছিলেন তিনি আসছেন অগ্রজদের চ্যালেঞ্জ জানাতে। চ্যালেঞ্জটা তিনি ভালোভাবেই দিয়েছেন ক্যারিয়ারে প্রথম জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়ে।

সুমাইয়া জাতীয় যুব অ্যাথলেটিকসে দুইবার রেকর্ড গড়ে স্বর্ণ জিতেছিলেন ১০০ ও ২০০ মিটার স্প্রিন্টে। ২০১৮ সালে জুনিয়র মিটে তিনি স্বর্ণ পেয়েছিলেন ১০০ মিটার, ২০০ মিটার, ১০০ মিটার রিলে, উচ্চলম্ফ ও দীর্ঘলম্ফে। পরের আসরেও ৫ স্বর্ণ জিতেছিলেন। ২০২০ সালে শুধু উচ্চলম্ফের স্বর্ণটি ধরে রাখতে পারেননি। ৪৫তম জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপের মাধ্যমে তার অভিষেক হয় সিনিয়র মিটে। প্রথম অংশ গ্রহনেই ১০০ ও ২০০ মিটারে স্বর্ণ জেতেন মানিকগঞ্জের এই ষোড়শী।
নতুন প্রতিদ্বন্দ্বীকে আন্তরিকভাবেই স্বাগিত জানিয়েছিলেন শিরিন আক্তার। ১০০ ও ২০০ মিটারে তাকে হারানোর পর দুবারই সুমাইয়াকে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন শিরিন। এতদিনে তাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর একজনতো আসলেন।
শুধু শিরিনকে হারানোর চ্যালেঞ্জই সুমাইয়ার? না। মাত্র ১৭ বছরে দেশের দ্রুতম মানবী হওয়া সুমাইয়ার চোখ অনেক দূরে।
‘জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে স্বর্ণ পেয়ে আমার একটা স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। এখন ধীরে ধীরে উঠতে চাই। পদক জিততে চাই এসএ গেমসে। তারপর নিজেকে তৈরি করতে চাই এশিয়া পর্যায়ে অংশ নিয়ে ভালো করতে এবং সবশেষে অলিম্পিকে। আমার চোখ আসলে অলিম্পিকে। সেখানে খেলে ভালো করতে হলে আগের ধাপগুলোতে পার হয়ে আসতে হবে’ - বলছিলেন সুমাইয়া।

বাবা খেলতেন ফুটবল। সুমাইয়ারা তিন বোন। তিনি সবার বড়। পরিবারের অন্য কেউ খেলাধুলা করেন না। ফুটবলার তজুমদ্দিন দেওয়ানের স্বপ্ন ছিল তার বড় মেয়েকে ঘিরেই। সবসময় উৎসাহ দিতেন। মেয়ে বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ার পর তার স্বপ্ন আরও বেড়ে গিয়েছিল। ‘বাবার স্বপ্ন’ পূরণ করেছেন সুমাইয়া বাবাকে হারানোর পর। সুমাইয়াদের পরিবারের আয়ের উৎস নিজেদের জমিজমা। বাবা মারা যাওয়ার পর এখন সুমাইয়াদের জমিজমা দেখাশুনা করেন তার চাচা ও চাচাতো ভাইয়েরা।
সাফল্যের এ পর্যায়ে আসার পেছনে বাবা-মায়ের পাশাপাশি বিকেএসপির সিনিয়র অ্যাথলেটিকস কোচ ড. মেহেদী হাসানের অবদানের কথা উল্লেখ করেছেন সুমাইয়া। শিরিন ও সুমাইয়া দুজনকেই খুব কাছ থেকে দেখা কোচ ড. মেহেদী তাদের প্রতিভাকে আলাদা করলেন এভাবে, ‘আসলে দুইজনই মেধাবী। শিরিন অনেক লড়াই করে নিজের অবস্থান দীর্ঘদিন ধরে রেখেছে। তবে একটু হলেও সুমাইয়া ভালো শিরিনের চেয়ে। তবে তাকে জায়গা ধরে রাখতে অনেক পরিশ্রম করতে হবে। আমাদের দেশের অ্যাথলেটদের সমস্যা ৬০ ভাগ পর্যন্ত ভালো থাকা সত্ত্বেও ফিনিশিংটা ভালো হয় না। সুমাইয়ার এক জায়গাটায় বেশ উন্নতি হয়েছে। স্টার্ট থেকে ফিনিশিং ভালো।’
প্রথমবার জিতেই শিরিনকে অতিক্রম করার যে চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন সুমাইয়াকে সেটাও পজিটিভভাবে দেখছেন বিকেএসপির কোচ ড. মেহেদী হাসান, ‘ওরা যদি একজন আরেকজনকে হারাতে চায় তাহলে আমাদের অ্যাথলেটিকসই লাভবান হবে। শিরিন এমনিতেই ওয়েল মোটিভেটেড। সুমাইয়াকে আরো পরিশ্রম করতে হবে, সময় গড়ানোর সাথে সাথে সে আরো ভালো করবে।’
আরআই/আইএইচএস/এএসএম