ডা. মুরাদের বাড়িতে ফরমায়েশ খাটা মুকুল এখন সরিষাবাড়ীর আতঙ্ক

নাসিম উদ্দিন নাসিম উদ্দিন , জেলা প্রতিনিধি, জামালপুর জামালপুর
প্রকাশিত: ১২:৩৭ পিএম, ০৮ ডিসেম্বর ২০২১

জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার চার লক্ষাধিক মানুষের আতঙ্কের নাম ডা. মুরাদ হাসান পরিচালিত ‘মুকুল বাহিনী’। এই বাহিনীর প্রধান সাখাওয়াত আলম মুকুল। তিনি সদ্য সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রীর কথিত প্রতিনিধি। তার নেতৃত্বে এতদিন পুরো উপজেলায় চলেছে সরকারি বরাদ্দের হরিলুট, টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজি।

মুরাদ হাসান ইস্যুতে বর্তমানে মুকুল আত্মগোপনে রয়েছেন। দুদিন হলো তার অফিসে গিয়েও মিলছে না দেখা।

জানা গেছে, সরিষাবাড়ী উপজেলার ভাটারা ইউনিয়নের চৌখা গ্রামের শাহজাহান আলী সেকের ছেলে সাখাওয়াত আলম মুকুল। জামালপুর-৪ (সরিষাবাড়ী) আসনে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ডা. মুরাদ হাসান এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর তার বাড়ির ফরমায়েশ খাটতেন দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা এই মুকুল। একপর্যায়ে ওই বাড়ির কাজের মেয়ে মোর্শেদা আক্তারকে বিয়ে করেন তিনি।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মুরাদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে আওয়ামী লীগ থেকে তাকে মনোনয়ন না দেওয়া হলে মুকুল পড়ে যান বিপাকে এবং জীবন জীবিকার তাগিদে অটোরিকশা, সিএনজি এবং ভাড়ায় চালিত প্রাইভেটকার চালাতে শুরু করেন।

jagonews24

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ডা. মুরাদ হাসান পুনরায় এমপি নির্বাচিত ও প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হলে পুরো উপজেলায় কৌশলে একক আধিপত্য গড়ে তোলেন এবং চলতি বছরের পৌর নির্বাচনে সরিষাবাড়ী পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডে প্রায় ৭ জন কাউন্সিলর পদপ্রার্থী থাকলেও সবাইকে ক্ষমতার দাপটে মাঠছাড়া করেন। পরে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পৌর কাউন্সিলর নির্বাচিত হন এই মুকুল। বর্তমানে চলাফেরা করেন বিলাসবহুল প্রাইভেটকারে। তাছাড়াও নামে বেনামে রয়েছে জায়গা জমি।

অভিযোগ রয়েছে, উপজেলা পরিষদের সকল দপ্তরে মুকুলের হাত। তার অনুমতি ছাড়া একটি প্রকল্পও তালিকাভুক্ত হয় না। প্রকল্প বাস্তবায়ন (পিআইও) অফিসের অধীন বরাদ্দকৃত টিআর, জিআর, কাবিখা প্রকল্প সবগুলো মুকুলের পছন্দমতো নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। অতিদরিদ্রদের জন্য বরাদ্দকৃত ৪০ দিনের কর্মসংস্থান (ইজিপিপি) কর্মসূচির সিংহভাগ হরিলুট করা হয়েছে তার নেতৃত্বে। করোনা ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ত্রাণের চাল ও নগদ টাকা এবং ভিজিএফ প্রকল্পের চাল বরাদ্দ দেয় সরকার। মুকুলের নেতৃত্বে তা হরিলুট হলেও কাগজে-কলমে এর দায়ভার পড়ে পিআইও হুমায়ুন কবীরের উপর।

অভিযোগ তদন্তে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সমন্বিত জেলা কার্যালয় টাঙ্গাইল রেকর্ডপত্র তলব করে পত্র দেয়। এছাড়া সোলার হোম সিস্টেম ও ব্রিজ নির্মাণ কাজও মুকুলের পছন্দের লোকদের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়। কয়েক ধাপে আশ্রয়হীনদের জন্য উপজেলায় ২১২টি ঘর বরাদ্দ করে সরকার। কয়েকটি ঘর বিনামূল্যে দেওয়া হলেও বেশিরভাগ উপকারভোগীর কাছ থেকে নগদ টাকা উৎকোচ নিয়েছে মুকুল বাহিনী।

দেশের সর্ববৃহৎ যমুনা সার কারখানার এলাকায় দিনের পর দিন চলেছে নীরব চাঁদাবাজি। প্রতিবস্তা সার পরিবহন বাবদ দুই টাকা হারে প্রতিমাসে অর্ধ কোটি টাকা চাঁদাবাজি করে আসছেন মুকুল। এছাড়া কারখানার ভেতরে চাঁদাবাজি, উৎকোচ বাণিজ্য, দৈনিক হাজিরাভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্যও কথিত ওই বাহিনীর হাতে। এমনকি যমুনা নদী থেকে অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের নিয়ন্ত্রকও এই বাহিনী।

jagonews24

মুকুলের ত্রাস বাহিনীর সদস্য সাবেক ছাত্রদল কর্মী শরিফ আহাম্মেদ নীরব (বামে) ও বিএনপি থেকে আসা একসময়ের দুর্ধর্ষ ক্যাডার বেলাল হোসেন

অভিযোগ রয়েছে, মুকুল বাহিনীর অন্যায়ে কেউ প্রতিবাদ করলে নেমে আসে ভয়াবহ নির্যাতন। বাস টার্মিনাল এলাকায় তিনি গড়ে তুলেছিলেন তার নিয়ন্ত্রণ অফিস। তার ত্রাস বাহিনীর সদস্য সাবেক ছাত্রদল কর্মী শরিফ আহাম্মেদ নীরব, বিএনপি থেকে আসা একসময়ের দুর্ধর্ষ ক্যাডার বেলাল হোসেন, এমডি রানা সরকার, সামিউল ইসলাম সামির, রফিকুল ইসলাম রফিক উল্লেখযোগ্য। মুকুল বাহিনীর সদস্যরা অধিকাংশই বিএনপি থেকে অনুপ্রবেশকারী হওয়ায় এদের হামলার হাত থেকে রেহাই পাননি আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের সিনিয়র ও ত্যাগী নেতাকর্মীরা।

জানা গেছে, গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর রাতে তারাকান্দিতে বিজয় দিবস পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম। এসময় সাখাওয়াত আলম মুকুলের নেতৃত্বে সশস্ত্র ক্যাডার সেখানে অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় উভয় গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধলে মুকুল বাহিনী রফিকুল ইসলামের লোকজনের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এ ঘটনায় উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন গুলিবিদ্ধ হয়ে চিরতরে একটি চোখ হারিয়ে ফেলেন।

এ ব্যাপারে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম জানান, এই স্মৃতি আজও ভুলতে পারি না। বিজয় দিবস উদযাপনের মঞ্চে মুকুল বাহিনী বিনা কারণে হামলা করে। তাদের গুলিতে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুনের ডান চোখ চিরতরে নষ্ট হয়ে গেছে। হামলাকারীরা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিও ভাঙচুর করে। এ ঘটনায় মামলা হলেও সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করেছে।

জানা গেছে, একইভাবে মুকুল বাহিনী ২০১৯ সালের ২১ আগস্ট উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আল-আমিন হোসাইন শিবলুর ওপর হামলা করে। এ ঘটনায় সরিষাবাড়ী থানায় মামলা (যার নম্বর ১৪, তাং ২১-০৮-২০১৯ইং) করা হয়।

গত বছরের ১৩ জানুয়ারি মুকুল বাহিনী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির তৎকালীন সদস্য আব্দুর রাজ্জাককেও মারধর করে। উপজেলার সাতপোয়া ইউনিয়নের চর সরিষাবাড়ী জিগাতলা এলাকায় কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের একটি অনুষ্ঠান চলাকালে এ ঘটনা ঘটে। পরে বিষয়টি নিয়ে ডা. মুরাদ হাসান কৃষিমন্ত্রীর কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন। তবে হামলাকারীদের কিছুই করা হয়নি।

jagonews24

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের ১ তারিখে (সোমবার) উপজেলার শিমলাবাজারের নির্বাচিত ৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুল হক তরফদারের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর, স্বর্ণালঙ্কার লুট ও নারীসহ অন্তত ১০ জনকে মারধর করে এ বাহিনী। পরাজিত প্রার্থী কালাচান পালকে নির্বাচনে জেতানোর জন্য চার লাখ টাকা চুক্তি নিয়ে ব্যর্থ হয়ে তারা ঘটনা ঘটায় বলে অভিযোগ রয়েছে।

এছাড়া তাদের হাতে শিমলাবাজারের ব্যবসায়ী রাজু আহমেদের ওষুধ ও প্রিন্টার্স ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে কর্মচারীদের লাঞ্ছিত করা হয়, ব্যবসায়ী আব্দুল আলিম ও পিডিবি অফিসে দেলোয়ারসহ কয়েকজন কর্মচারী মারধরের শিকার হন এবং উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ফরিদুল কবীর শামীম, সাবেক পৌর মেয়র রোকুনুজ্জামান রোকন ও মেয়র ফয়েজুল কবীর শাহীন কয়েকবার লাঞ্ছিত হন।

সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রীর প্রোগ্রাম চলাকালীন সময়ে লোডশেডিংকে কেন্দ্র করে পিডিবর কর্মচারীর ওপর হামলার ঘটনাও ঘটে। এ বিষয়ে পিডিবির কর্মচারী বশির উদ্দিন জানান, বিদ্যুতের রুটিন লোডশেডিং দেওয়ায় ‘মুকুল ভাই’ ক্ষিপ্ত হয়ে পিডিবিতে এসে কয়েকজনকে মারধর করেন। এজন্য ডা. মুরাদ হাসান ফোন করে ‘স্যরিও’ বলেন।

এদিকে মুকুল বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পাননি স্থানীয় সাংবাদিকরাও। খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল চুরি সংক্রান্ত সংবাদ পরিবেশন করায় গত বছরের ১০ এপ্রিল রাতে মুকুলের নেতৃত্বে সাংবাদিক নাসিম উদ্দিনের বাসায় ঢুকে তার স্ত্রীর সামনে থেকে তুলে নিয়ে যায়। পুলিশের সহায়তায় নাসিম উদ্দিনকে মধ্যরাত পর্যন্ত থানায় আটকে রেখে মানসিক নির্যাতন করা হয়। পরে তাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে সাদা কাগজে স্বাক্ষর আদায় ও সাংবাদিকতা বাদ দেওয়ার শর্তে ছেড়ে দেয়।

শুধু নাসিম উদ্দিনই নয়; চাল চুরির সংবাদকে কেন্দ্র করে মমিনুল ইসলাম কিসমতকে এই বাহিনী একাধিকবার প্রাণনাশের হুমকি দেয়।

যমুনা সার কারখানার দুর্নীতি-চাঁদাবাজির সংবাদ পরিবেশন করায় লাঞ্ছিত করা হয় জেলার সাংবাদিক দুলাল হোসাইনকে। এ বাহিনীর ছিনতাই-চাঁদাবাজির সংবাদ প্রকাশ করায় সর্বশেষ ৬ অক্টোবর সাংবাদিক জাকারিয়া জাহাঙ্গীরকে মুকুলের নেতৃত্বে ঘেরাও করে অকথ্য ভাষায় গালাগাল এবং প্রাণনাশের হুমকি দেয়।

সাংবাদিক জাকারিয়া জাহাঙ্গীর বলেন, গণমাধ্যমকর্মীদের স্বার্থ রক্ষায় তথ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু সে মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীই ছিলেন তার এলাকার সাংবাদিকদের জন্য আতঙ্কের কারণ। যারাই তার বাহিনীর বিরুদ্ধে সংবাদ করেছে তাদেরকেই নানাভাবে হয়রানি করা হয়েছে।

মুকুল বাহিনীর প্রধান সাখাওয়াত আলম মুকুলের বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগও রয়েছে। যার একটি অডিও ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মুকুল জাগো নিউজকে মুঠোফোনে জানান, আমি কখনও অটোরিকশা চালাইনি। আমি একজন কাউন্সিলর, কাউন্সিলর হিসেবে সবসময় জনগণের সেবায় নিয়োজিত আছি। আমি ত্রাস নই, আমার কোনো বাহিনীও নেই। আর যে গাড়িটি দেখতে পাচ্ছেন সেটি আমি ব্যাংক লোন করে কিনেছি।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছানোয়ার হোসেন বাদশা জাগো নিউজকে বলেন, সাখাওয়াত আলম মুকুল নামে কেউ আওয়ামী লীগের পদ-পদবিতে নেই। কিন্তু দলের নাম ভাঙিয়ে তার নেতৃত্বে যা হয়েছে তা নিয়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে এবং দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক উপাধ্যক্ষ হারুন অর রশিদ জানান, মুকুল এতদিন দলের নাম ভাঙিয়ে মুরাদ হাসানের ছত্রছায়ায় সরিষাবাড়ীতে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে ভীতি সঞ্চার করেছিলো। অথচ দলের জন্য তার কোনো অবদানই নেই। তার জন্য আমরা বিব্রত।

এফএ/এমএস

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।