চার স্তম্ভে দাঁড়াবে স্মার্ট বাংলাদেশ

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৪:১০ পিএম, ০১ জুন ২০২৩

‘উন্নয়নের অভিযাত্রার দেড় দশক পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা’ শিরোনামে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে এক লাখ এক হাজার ২৭৮ কোটি টাকা বেশি।

বৃহস্পতিবার (১ জুন) জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা এ বাজেট স্বাধীন বাংলাদেশের ৫২তম বাজেট। আওয়ামী লীগ সরকারের ২৪তম বাজেট এটি। অর্থমন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামালের টানা পঞ্চম বাজেট।

নতুন অর্থবছরের এই বাজেট প্রস্তাব দিতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, চারটি মূল স্তম্ভের ওপর স্বপ্নের স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে রয়েছে- স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট সরকার, স্মার্ট সোসাইটি ও স্মার্ট ইকোনমি।

বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ সালের সরকার গঠন করার প্রাক্কালে জাতির সামনে রূপকল্প ২০২১ পেশ করা হয়েছিল, যার মূল লক্ষ্য ছিল অর্থনেতিকভাবে সমৃদ্ধশালী সমতাভিত্তিক ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ। গত দেড় দশকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, বৈজ্ঞানিক ও অবকাঠামোসহ সব ক্ষেত্রে যে অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধন করেছে, তার মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের একটি টেকসই ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে।

তিনি বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জনে প্রধানমন্ত্রীর চিন্তাপ্রসূত 'স্মার্ট বাংলাদেশ' গঠনের উদ্যোগসমূহ কার্যকর ভূমিকা রাখবে। স্বপ্নের সে স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে চারটি মূল স্তম্ভ- স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট সরকার, স্মার্ট সোসাইটি ও স্মার্ট ইকোনমির ওপর ভিত্তি করে।

তিনি বলেন, আমাদের স্মার্ট বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় হবে কমপক্ষে ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার। দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকবে ৩ শতাংশের কম মানুষ। আর চরম দারিদ্র্য নেমে আসবে শূন্যের কোঠায়। মূল্যস্ফীতি সীমিত থাকবে ৪-৫ শতাংশের মধ্যে। বাজেট ঘাটতি থাকবে জিডিপির ৫ শতাংশের নিচে। রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত হবে ২০ শতাংশের ওপরে। বিনিয়োগ হবে জিডিপির ৪০ শতাংশ। শতভাগ ডিজিটাল অর্থনীতি আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক স্বাক্ষরতা অর্জিত হবে। সবার দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে যাবে। স্বয়ংক্রিয় যোগাযোগ ব্যবস্থা, টেকসই নগরায়ণসহ নাগরিকদের প্রয়োজনীয় সব সেবা থাকবে হাতের নাগালে। তৈরি হবে পেপারলেস ও ক্যাশলেস সোসাইটি। সবচেয়ে বড় কথা, স্মার্ট বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হবে সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা।

অর্থমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের এ যাবৎ সব অর্জনে কৃতিত্বের দাবিদার আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এরপর একটি কবিতা শোনান অর্থমন্ত্রী। কবিতাটি নিচে তুলে ধরা হলো-

বাঙ্গালীকে প্রথম স্বপ্ন দেখিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
এনে দিয়েছেন এক রক্তস্নাত স্বাধীনতা মহান।
মজবুত ভিত স্থাপন করে শুরু করেছিলেন সোনার বাংলা গড়ার
কিন্তু বিশ্বাসঘাতকের বুলেট সুযোগ দেয়নি তা সমাপ্ত করার।
তবে দাবায়ে রাখতে পারেনি কেউ, কারণ হাল ধরেছেন শেখ হাসিনা
রচনা করছেন একের পর এক উন্নয়ন পরিক্রমা।
গড়েছেন ডিজিটাল-উন্নয়নশীল বাংলাদশে

উন্নয়নের নেই কো কোনো শেষ
২০৪১ এর মধ্যে হবে স্মার্ট উন্নত সোনার বাংলাদেশ।

এরপর অর্থমন্ত্রী বলেন, আজকের এ মাহেন্দ্রক্ষণে আমরা দেশবাসী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা।

তিনি বলেন, চলতি মেয়াদের জন্য আমাদের সরকারের অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল ‘টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন - সমৃদ্ধ বাংলাদেশ’। প্রধানমন্ত্রী পূর্বেই ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন। এখন তিনি জনগণের জন্য সর্বোচ্চ কল্যাণকর এক স্মার্ট বাংলাদেশের অভিনব রূপকল্প আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন।

এ প্রেক্ষাপটে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যসমূহ অর্জনের জন্য চলতি অর্থবছর ও মধ্যমেয়াদে যে নীতি-কৌশলসমূহ অনুসরণ করা হয়েছে জাতীয় সংসদের সামনে তা তুলে ধরেন অর্থমন্ত্রী।

তিনি বলেন, কোভিড-১৯ অতিমারি বিশ্বব্যাপী জীবন-জীবিকাসহ আর্থসামাজিক অবস্থাকে বিপর্যস্ত করেছে। কোভিডের অভিঘাতে আমাদের দেশেও জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০১৯-২০ সময়ে হ্রাস পেয়ে ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশে নেমে আসে। তবে অধিকাংশ দেশেই তখন প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক। আমাদের সরকার কোভিড পরিস্থিতি অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করেছে।

অর্থমন্ত্রী বলেন, ওই সময়ে সরকার প্রবৃদ্ধির তুলনায় জনগণের জীবন ও জীবিকা সুরক্ষা এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। রাজস্ব ও মুদ্রানীতির প্রাজ্ঞ ও সুসমন্বিত প্রয়োগ এবং অর্থনীতির অন্তর্নিহিত শক্তিতে কোভিড পরবর্তী বছরেই বাংলাদেশ উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরে আসে। কিন্তু, আমাদের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া দ্রুত হলেও বিশ্বব্যাপী কোভিড- ১৯ এর অভিঘাত দীর্ঘায়িত হয়। এর সঙ্গে ২০২২ এর ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত বিশ্ব ভূ-রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করে। বিশ্বব্যাপী আরও শ্লথ হয়ে আসে প্রবৃদ্ধির গতিধারা। এর কিছুটা বিলম্বিত প্রভাব আমাদের পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াকেও ব্যাহত করে।

তিনি বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে মূল্যস্ফীতি, সরকারি ব্যয়, লেনদেনের ভারসাম্য, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও মুদ্রা বিনিময় হারের ওপর। যুদ্ধ ও যুদ্ধকেন্দ্রিক নিষেধাজ্ঞার প্রভাবে আন্তর্জাতিক সরবরাহ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। তখন বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্য, সার ও জ্বালানি তেলের মূল্য অনেকখানি বেড়ে যায়। নজিরবিহীন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে উন্নত দেশসমূহ, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধাপে ধাপে নীতি সুদের হার বাড়িয়েছে। বৈশ্বিক পরিমণ্ডলের এসব পরিবর্তন আমাদের অর্থনীতিকেও প্রভাবিত করছে। উল্লেখ্য, যুদ্ধ-পূর্ববর্তী দশকে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি ৫-৬ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। অথচ, যুদ্ধ শুরুর পর বৈশ্বিক মূল্যবৃদ্ধি ও দেশে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের অবচিতির কারণে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির ফলে পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি বেড়ে আগস্ট ২০২২ সময়ে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ হয়। ফলে, চলতি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখা সম্ভব হবে না।

মূল্যস্ফীতি ছাড়াও বর্ধিত আমদানি ব্যয় বাংলাদেশের আমদানি-নির্ভর অর্থনীতির ওপর নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করছে বলে জানান অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে সার, জ্বালানি তেল ও গ্যাসের অত্যধিক মূল্য বৃদ্ধির কারণে ভর্তুকি প্রণোদনা বাবদ বরাদ্দ ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে জিডিপির এক দশমিক ৮৩ শতাংশে উন্নীত করতে হয়, সংশোধিত বাজেটে এ বরাদ্দ আরও বেড়ে জিডিপির দুই দশমিক ২২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অথচ যুদ্ধ-পূর্ববর্তী বছরগুলোতে ভর্তুকি প্রণোদনা খাতে বরাদ্দ গড়ে জিডিপির এক শতাংশের মধ্যে সীমিত ছিল।

অর্থমন্ত্রী বলেন, আমদানি প্রবৃদ্ধি ২০১৯-২০ অর্থবছরের ৮ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে ২০২১- ২২ সময়ে ৩৫ দশমিক ৯ শতাংশে বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবাস আয় পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ হ্রাস পায়। বহিঃখাতে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও প্রবাস আয় হ্রাসের ফলে চলতি হিসাবে ঘাটতি ২০২০- ২১ অর্থবছরের ৪ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে ২০২১-২২ সময়ে ১৮ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়ায়। পাশাপাশি, রপ্তানি আয় প্রত্যাবাসন ও বৈদেশিক সাহায্যনির্ভর প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির ফলে আর্থিক হিসাবও নেতিবাচক অবস্থানে চলে আসে। চলতি হিসাব ও আর্থিক হিসাবের যুগপৎ ঘাটতি লেনদেন ভারসাম্য পরিস্থিতির অবনতি ঘটায়।

তিনি বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ জুন ২০২১ এর ৪৬ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হতে কমে জুন ২০২২ এ ৪১ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন এবং ক্রমান্বয়ে আরও হ্রাস পেয়ে বর্তমানে ২৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমে এসেছে। একই সঙ্গে মার্কিন ডলারের তুলনায় টাকার মূল্যমান কমেছে। জুন ২০২২ সময়ে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার ছিল ডলার প্রতি ৯৩ দশমিক ৫ টাকা। সর্বশেষ ২৪ মে ২০২৩ তারিখে বিনিময় হার দাঁড়িয়েছে প্রতি ডলার ১০৮ দশমিক ১ টাকায়। বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক এর প্রাথমিক চেষ্টা বাজারে সাময়িক তারল্য সংকট তৈরি করে। এর প্রভাবে ব্যাংক উৎস হতে ঘাটতি অর্থায়নে সরকারের সুদ ব্যয় বাড়ে।

এমএএস/কেএসআর/জেআইএম

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।