ইসলামী কঠোর ‘বিধান’ থেকে ‘নমনীয়’ কূটনীতি, যেমন চলছে তালেবানের পররাষ্ট্রনীতি
চলতি বছরের আগস্টে আফগানিস্তানে ক্ষমতায় আসার চতুর্থ বর্ষপূর্তি উদযাপন করেছে তালেবান। ২০২১ সালের আগস্টে ক্ষমতা দখলের পর থেকে এই গোষ্ঠী দেশটির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে ও এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না পেলেও বিশ্বের বহু দেশের সঙ্গে সক্রিয় কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। এরই মধ্যে ভারতসহ বহু রাষ্ট্র তালেবানকে কার্যত আফগানিস্তানের শাসক হিসেবে মেনে নিয়েছে, বিশেষত মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকাকে গুরুত্ব দিয়ে। তবে একই সঙ্গে, আফগান ভূখণ্ডে সন্ত্রাসী সংগঠনের উপস্থিতি ও নিরাপত্তাজনিত অনিশ্চয়তা এখনো আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগের কারণ।
এই প্রেক্ষাপটে, গবেষক ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রনীতির প্রকৃতি ও মূল বৈশিষ্ট্য নিয়ে আগ্রহ বাড়ছে। প্রশ্ন উঠেছে- তালেবান আদৌ কোনো সুসংগঠিত নীতি বা আদর্শের ভিত্তিতে পররাষ্ট্র কার্যক্রম পরিচালনা করে কি না। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া গেলে তালেবানদের আন্তর্জাতিক আচরণ বোঝা সহজ হবে ও ভবিষ্যতে তাদের পররাষ্ট্রনীতির দিকনির্দেশনা অনুমান করা সম্ভব হবে।
আদর্শিক ভিত্তি ও বাস্তবতা
তালেবানদের রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম ভিত্তি হলো তাদের নেতা রচিত ‘রোহনামুদহো আমির আল-মুমিনিন বারোয়ে মুজাহিদিন’ নামের পুস্তক। এই গ্রন্থের নীতিমালা আফগানিস্তানের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজে গভীর প্রভাব ফেলেছে। তবে বর্তমানে পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে তালেবানদের আচরণ অনেক ক্ষেত্রেই এই কাঠামো থেকে কিছুটা বিচ্যুত হয়ে তুলনামূলক বাস্তববাদী ও নমনীয় কূটনৈতিক পন্থা অনুসরণ করছে।
প্রথাগত নীতির প্রভাব
তালেবান মতাদর্শের দুটি মূল উপাদান হিসেবে সাধারণত দেওবন্দি মতবাদ ও পশতুনওয়ালি আচরণবিধিকে ধরা হয়। এই দুটি উপাদান তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ ও পররাষ্ট্রনীতিতেও গভীর প্রভাব ফেলেছে।
দেওবন্দি মতবাদ হলো ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে শুরু হওয়া একটি আন্দোলন, যার মূল লক্ষ্য ছিল ইসলামি শিক্ষা, সুন্নাহর বিশুদ্ধ অনুশীলন প্রচার করা ও বিদআত (নতুন ধর্মীয় উদ্ভাবন) প্রত্যাখ্যান করা। এই আন্দোলনের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হলো শরিয়তের কঠোর অনুসরণ, তাওহিদের ওপর জোর দেওয়া ও ঔপনিবেশিক শাসনের বিরোধিতা করা।
অন্যদিকে, পশতুন জনগণের ঐতিহ্যবাহী জীবনধারা, আচরণবিধি ও সামাজিক নিয়মের একটি সমষ্টিকে বলা হয় পশতুনওয়ালি। এটি মূলত আতিথেয়তা, সম্মান, প্রতিশোধ এবং ন্যায়বিচার ও অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী আইনের উপর ভিত্তি করে গঠিত একটি সামাজিক বিধান।
তালেবানের পররাষ্ট্রনীতিতে এই দুটি মতাদর্শের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায় সীমান্তবর্তী পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায়। ২০২৫ সালের মে মাসে উজবেকিস্তানে নিযুক্ত তালেবান রাষ্ট্রদূত আব্দুল গফফার তিরাওয়ি কুশ-তেপা খাল প্রকল্প নিয়ে বলেন, ‘পানি অপচয় করা উচিত নয়।’ একইভাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি ইরানের সঙ্গে হেলমান্দ নদী চুক্তি প্রসঙ্গে বলেন, এটি আমাদের ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ব। কোনো মুসলমান যদি তৃষ্ণায় কষ্ট পান ও আমরা সহায়তা করতে পারি, তবে তা একটি সৎকর্ম ও যুক্তিসঙ্গত নীতি।
এসব মন্তব্য থেকে বোঝা যায়, তালেবানদের কূটনীতিতে ইসলামি মূল্যবোধ এখনো একটি আদর্শিক দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করছে।
পশতুনওয়ালির ভূমিকা
পশতুনওয়ালির মৌলিক নীতি, বিশেষ করে পশতুন জাতীয়তাবাদ তালেবানদের পররাষ্ট্র আচরণেও দৃশ্যমান। তারা বহিরাগত চাপ প্রতিরোধে জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও ঐতিহ্যিক মর্যাদার কথা তুলে ধরে। ইতিহাসে যেমন দেখা গেছে, ১৯৯০-এর দশকে প্রথম দফায় ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় আন্তর্জাতিক চাপ সত্ত্বেও তালেবান ওসামা বিন লাদেনকে হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। একইভাবে বর্তমানে নারী ও মেয়েদের অধিকার প্রসারের ক্ষেত্রে জাতিসংঘ এবং পশ্চিমা দেশগুলোর চাপকে ‘দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ’ হিসেবে দেখছে তারা।
সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কঠোর অবস্থান ও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কে চরম অবনতি
তালেবানদের বর্তমান পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রে রয়েছে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের নীতি। এর সবচেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ- তাদের পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক। যদিও ১৯৯০-এর দশকে ইসলামাবাদ তালেবানকে সামরিক ও গোয়েন্দা সহায়তা দিয়েছিল, কিন্তু ২০২১ সালে ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে তালেবান ধীরে ধীরে পাকিস্তান থেকে দূরত্ব তৈরি করছে।
ডুরান্ড রেখা ঘিরে উত্তেজনা, পরস্পরের প্রতি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ ও পাকিস্তানের স্বীকৃতি না দেওয়া- সবকিছু মিলিয়ে দুই দেশের সম্পর্কে নতুন ধরনের টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। এখন আফগান রাজনৈতিক মহলে পাকিস্তানের ‘ছোট ভাই’ হিসেবে পরিচিতি থেকে মুক্তি পেতে চায় তালেবান, যা তাদের স্বাধীন ও আত্মমর্যাদাবোধের প্রতিফলন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
নিরপেক্ষতা ও হস্তক্ষেপমুক্ত নীতি
বিশ্লেষকদের মতে, তালেবানদের বর্তমান পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি ‘নিরপেক্ষতা’ ও ‘হস্তক্ষেপমুক্ত’ নীতিতে দাঁড়িয়ে। বিশেষত মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর ক্ষেত্রে তারা তাদের মতাদর্শ রপ্ত না করে কেবল আফগান ভূখণ্ডে শরিয়াহ প্রয়োগ সীমিত রাখছে। তবে বাস্তবে এই নীতি সবসময় কার্যকর নয়।
তালেবানদের বিরুদ্ধে টিটিপি (তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান) সমর্থনের অভিযোগ, পাকিস্তান সীমান্তে সংঘাত, গাজা যুদ্ধের সময় ইরানের প্রতি সংহতি প্রকাশ ও ‘তেহরিক-ই-তালেবান কাশ্মীর’ নামের একটি গোষ্ঠীর উদ্ভব- সবকিছুই দেখায় যে তাদের হস্তক্ষেপমুক্ত নীতি অনেক সময় কাগুজে থেকে যায়।
স্বীকৃতির কূটনীতি
চার বছর ক্ষমতায় থাকার পরও এখন পর্যন্ত রাশিয়া ছাড়া কোনো দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। ফলে তাদের কূটনৈতিক কার্যক্রমের প্রধান লক্ষ্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন।
এই লক্ষ্য পূরণে তারা এখন শুধু ইসলামি দেশ নয়, বরং ভারত, জাপান, নিকারাগুয়া, বুরকিনা ফাসোসহ বিভিন্ন অমুসলিম দেশের সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ে তুলছে। এই কূটনৈতিক বহুমুখীকরণ তালেবানদের প্রচলিত আঞ্চলিক পরিসর ছাড়িয়ে বৈশ্বিক সম্পর্ক ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ইঙ্গিত দেয়।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন মূল অগ্রাধিকার
তালেবানদের পররাষ্ট্রনীতিতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এখন মূল অগ্রাধিকার। তবে এ নিয়ে অভ্যন্তরীণ বিভাজনও স্পষ্ট। কাবুল-ভিত্তিক উপ-প্রধানমন্ত্রী মোল্লা আব্দুল ঘনি বারাদারের নেতৃত্বাধীন অংশটি তুলনামূলক বাস্তববাদী ও উন্নয়নমুখী নীতি অনুসরণ করছে। এই ধারা ধীরে ধীরে পুরো সরকারের নীতিনির্ধারণে প্রভাব ফেলছে।
চীন, ভারত ও রাশিয়ার সঙ্গে তালেবানদের ক্রমবর্ধমান যোগাযোগ এই বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন। অতীতে যেসব দেশকে ‘অবিশ্বাসী’ হিসেবে দেখা হতো, এখন তাদের সঙ্গেও অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক বাড়ানো হচ্ছে।
বহুপাক্ষিক কূটনীতির দিকে ঝোঁক
তালেবান এখন একক সম্পর্কের বাইরে গিয়ে ত্রিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সহযোগিতার পথে হাঁটছে। ২০২৫ সালের ২১ মে চীন, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে নিরাপত্তা, অবকাঠামো ও বাণিজ্য সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়।
এদিকে, তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তানের সঙ্গে সাম্প্রতিক বৈঠকেও জ্বালানি সহযোগিতা ও কাসা-১০০০ প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে কথা হয়। এছাড়া জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে দোহা সম্মেলনগুলোতে অংশগ্রহণের মাধ্যমেও তালেবান বৈশ্বিক কূটনীতিতে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করার চেষ্টা করছে।
মধ্য এশিয়া অগ্রাধিকারে
তালেবান সরকারের পররাষ্ট্র অগ্রাধিকারের তালিকায় মধ্য এশিয়ার দেশগুলো বিশেষ স্থান দখল করেছে। বিশেষত উজবেকিস্তানসহ এই অঞ্চলের দেশগুলো আফগানিস্তানকে এখন মধ্য এশিয়ার অংশ হিসেবেই দেখতে শুরু করেছে। এ কারণেই তালেবানও তাদের সঙ্গে জ্বালানি, প্রযুক্তি ও মানবিক সহযোগিতা বৃদ্ধিতে আগ্রহী। টিএপিআই, কাসা-১০০০ ও ট্রান্স-আফগান করিডোরের মতো প্রকল্পগুলো এ অঞ্চলে আফগানিস্তানের সংযোগ আরও দৃঢ় করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সামগ্রিকভাবে দেখা যায়, তালেবান এখনো পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক পররাষ্ট্রনীতি নথি প্রকাশ করেনি, তবে তাদের কূটনৈতিক দিকনির্দেশনা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। ইসলামি মূল্যবোধ ও পশতুন ঐতিহ্যের পাশাপাশি তারা এখন নিরপেক্ষতা, সার্বভৌমত্ব, অর্থনৈতিক বাস্তববাদ ও বহুপাক্ষিক সম্পৃক্ততার দিকে ঝুঁকছে। মধ্য এশিয়া এখন তাদের কূটনৈতিক অগ্রাধিকারে পরিণত হয়েছে, আর পশ্চিমা দেশগুলোর ভূমিকা নির্ভর করবে তারা আফগানিস্তান নিয়ে কতটা সমন্বিত নীতি গ্রহণ করতে পারে তার ওপর।
সূত্র: দ্য ডিপ্লোম্যাট
এসএএইচ