ডাকসুর কাজ কী, জানেন না অনেক শিক্ষার্থী

আল-আমিন হাসান আদিব
আল-আমিন হাসান আদিব আল-আমিন হাসান আদিব , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:৩১ পিএম, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

• মুক্তিযুদ্ধ-গণতন্ত্র ও শিক্ষার্থীর অধিকার রক্ষাই মূল লক্ষ্য
• বক্তৃতা-বিতর্ক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করাই ডাকসুর কাজ
• ‘অনিয়মিত নির্বাচনে’ ডাকসুর কাজ ভুলেছেন শিক্ষার্থীরা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন আগামী মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর)। এ নির্বাচনে ভোটার শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরাই। অথচ দেশজুড়ে এখন আলোচনার কেন্দ্রে ডাকসু। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের কল্যাণে এ নির্বাচনের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামেও।

ডাকসু ভবন দেখা তো দূরে থাক, হয়তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতেও পা পড়েনি এমন ব্যক্তিরাও মেতে আছেন এ নির্বাচন নিয়ে। প্রার্থীদের মধ্যে কে যোগ্য, কে অযোগ্য- তা নিয়েও করছেন চুলচেরা বিশ্লেষণ। এমনকি অনেকে ডাকসু কী, এর কাজ কী, বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে ডাকসুর নির্বাচিত নেতাদের দায়িত্ব কতটা, তাও জানেন না।

ডাকসুর কাজ কী, জানেন না অনেক শিক্ষার্থী

এ তো গেলো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের জগতের মানুষের কথা। খোদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীও ডাকসুর কাজ সম্পর্কে অবগত নন। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া অনেক ভিডিওতে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাগতসহ অনেক শিক্ষার্থী এ নিয়ে কিছুই জানেন না বলে গণমাধ্যমে সরল স্বীকারোক্তি দিচ্ছেন। দীর্ঘদিন ডাকসু নির্বাচন বন্ধ থাকায় এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের জানাশোনা খুবই কম।

ডাকসুর কাজ কী, জানেন না অনেক শিক্ষার্থীও

২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে ভর্তি হওয়া নাজনীন নাহার জাগো নিউজকে বলেন, ‘ক্যাম্পাসে আসার পর ডাকসু ভবনকে ক্যান্টিন মনে করতাম। ভাবতাম এখানে মনে হয়, চা-নাশতা পাওয়া যায়। পরে একদিন বন্ধুদের সঙ্গে ঢুকে কিছু ধারণা পেয়েছিলাম। তবে ডাকসুর আসলেই কাজ কী, তা নিয়ে আমি স্পষ্ট নই।’

‘ডাকসু তো শুধু ঢাবির গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়, সারাদেশের শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়, দাবি-দাওয়ার আন্দোলনের বাতিঘর। অনিয়মিত নির্বাচন ও দেশে অগণতান্ত্রিক পরিস্থিতির কারণে ডাকসুর তেজ হারিয়ে গেছে, শিক্ষার্থীরাও ভুলতে বসেছে।’— ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষার্থী আসাদুল ইসলামও একই কথা জানান। তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পাসে তো প্রায় সাড়ে তিন বছর এসেছি। ডাকসু নিয়ে শুনেছি, এখন নির্বাচন নিয়ে খুব মাতামাতি চলছে। কিন্তু সত্যি বলতে এ নিয়ে আমার আগ্রহ নেই। আমি জানিও না ডাকসুর কাজ কী? এটাকে পুরোটাই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবে বিবেচনা করি আমি। আমাদের বিভাগে পড়ালেখার যে চাপ, তাতে রাজনীতি নিয়ে ভাবার বা ডাকসুর আমেজে গা ভাসানোর মতো সুযোগ নেই।’

প্রায় ছয় বছর ধরে ঢাকায় রিকশা চালান আরুজ আলী। সবশেষ দেড়-দুই বছর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও এর আশপাশে রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। আজ (৪ সেপ্টেম্বর) দুপুরে শাহবাগ থেকে তার রিকশায় চড়ে পল্টন মোড়ে আসার পথে পুরোটা সময় জাগো নিউজের এ প্রতিবেদককে ডাকসু নিয়েই গল্প শোনান আরুজ আলী।

ডাকসুর কাজ কী, জানেন না অনেক শিক্ষার্থী

রিকশা থেকে নামার আগে আরুজ আলীর কাছে ‘ডাকসুর কাজ কী’ প্রশ্ন করতেই হেসে ওঠেন। বলেন, ‘নেতা বানানো ছাড়া আর কী? যে দল জিতবো, হেই দলই ক্যাম্পাসে রাজত্ব করবো। হেইডাই তো জানি!’

ডাকসুর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

২০১৯ সালে সর্বশেষ যে ডাকসু নির্বাচন হয়, সে লক্ষ্যে গঠনতন্ত্রে কিছু সংশোধন আনা হয়েছিল। সেই গঠনতন্ত্রে ডাকসুর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল পাঁচটি। তবে এবারের নির্বাচন সামনে রেখে গঠনতন্ত্রে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। তাতে ডাকসুর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের অংশে চব্বিশের ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানের চেতনাকে প্রতিষ্ঠা করার বিষয়টি নতুন করে যুক্ত করা হয়েছে।

সবশেষ গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ডাকসুর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলো হলো- স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ধারণ ও লালন করা, বৈষম্য ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের চেতনা এবং দেশের ইতিহাসে সংঘটিত বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চেতনা প্রতিষ্ঠিত করা, শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ও সহপাঠ কার্যক্রমে সর্বোচ্চ উৎকর্ষে পৌঁছানো।

আবাসিক হলগুলোর শিক্ষার্থীদের মধ্যে পারস্পরিক সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সহযোগিতাকে উৎসাহিত করা, বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে সর্বোচ্চ একাডেমিক ও সহশিক্ষামূলক সুবিধা লাভ করা, শিক্ষার্থীদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা এবং তাদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি সৃষ্টি করা।

সবশেষে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত ও অধিভুক্ত কলেজ বা ইনস্টিটিউটগুলোর শিক্ষার্থী এবং বাংলাদেশ ও বহির্বিশ্বে অবস্থিত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্রাতৃপ্রতিম অন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে পারস্পরিক সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সহযোগিতাকে উৎসাহিত করতে হবে।

ডাকসুর নির্বাহী কমিটি ও নেতাদের কাজ কী?

ডাকসুর গঠনতন্ত্রে উল্লিখিত ভিপি-জিএসসহ ২৮ জন নির্বাচিত প্রতিনিধি ও পদাধিকারবলে উপাচার্য এবং উপাচার্য মনোনীত কোষাধ্যক্ষকে নিয়ে ৩০ সদস্যের কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হবে। তারা দায়িত্বগ্রহণের পর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কাজ শুরু করেন।

ডাকসুর কাজ কী, জানেন না অনেক শিক্ষার্থী

গঠনতন্ত্রে নির্বাহী কমিটির জন্য ৯টি সুনির্দিষ্ট পয়েন্টে কাজের কথা উল্লেখ রয়েছে। সেখানে বক্তৃতা, বিতর্ক, আবৃত্তি প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনই মূল কাজ হিসেবে উল্লেখ রয়েছে। পাশাপাশি সমাজসেবামূলক কাজে উৎসাহিত করার কথা বলা হয়েছে। কমিটির নির্বাচিত প্রতিনিধিদের এ কাজগুলো বাস্তবায়নে একক ও সমন্বিত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়াটাই ডাকসুর নেতাদের মূল কাজ।

ডাকসু ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ওপরে স্থান পেয়েছে শিক্ষার্থীদের অধিকার সমুন্নত রাখা। এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অধিকার সংরক্ষণ ও সুরক্ষার জন্য ছাত্রসংসদ সর্বদা সচেষ্ট থাকবে।’

গঠনতন্ত্রে এরপরই বলা হয়েছে, ছাত্রসংসদের সদস্যদের ব্যবহারের জন্য কমনরুম তত্ত্বাবধান করবে এবং সেখানে ইনডোর গেমস, দৈনিক পত্রিকা ও সাময়িকী সরবরাহ করবে।

ডাকসুর উদ্যোগে বছরে অন্তত একটি জার্নাল প্রকাশ করতে হবে এবং কার্যনির্বাহী কমিটির সিদ্ধান্ত ও সভাপতির অনুমোদন সাপেক্ষে অন্যান্য বুলেটিন, ম্যাগাজিন বা পত্রিকা প্রকাশ করবে।

বিভিন্ন সময়ে বিতর্ক, নাটক এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করবে, সাধারণ আগ্রহের বিষয়গুলো নিয়ে লেকচার আয়োজন করবে এবং যথাসম্ভব মিলনমেলার আয়োজন করা।

বছরে অন্তত একবার ডাকসুর নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে বক্তৃতা, বিতর্ক, আবৃত্তি, প্রবন্ধ ও ইনডোর গেমসের প্রতিযোগিতা আয়োজন করবে, প্রতিযোগিতাগুলো অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের জন্যও উন্মুক্ত হতে পারে।

সম্ভব হলে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক ও শিক্ষাবিষয়ক সম্মেলনগুলোতে প্রতিনিধি পাঠাবে। প্রতিবছর বিতর্ক প্রতিযোগিতার জন্য অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিনিধি পাঠাবে অথবা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানাবে।

সমাজসেবামূলক কার্যক্রমে উৎসাহ দেবে এবং বিভিন্ন কল্যাণমূলক বক্তৃতা, কর্মসূচি, প্রদর্শনী আয়োজন এবং সম্ভব হলে স্কুল পরিচালনার মাধ্যমে ছাত্রসংসদ সদস্যদের মধ্যে সামাজিক কাজের উদ্দীপনা জাগ্রত করতে হবে।

কার্যাবলি অংশের সবশেষে বলা হয়েছে, ডাকসুর কার্যনির্বাহী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এবং সভাপতির (উপাচার্য) অনুমোদন সাপেক্ষে অন্যান্য কাজ সম্পাদন করতে হবে।

অনিয়মিত নির্বাচনে ডাকসুর কাজ সম্পর্কে ভুলেছেন শিক্ষার্থীরা!
ডাকসু সম্পর্কে শিক্ষার্থীরাই সঠিকভাবে জানেন না— এর পেছনে ‘অনিয়মিত নির্বাচন আয়োজনই’ দায়ী বলে মনে করেন ডাকসুর সাবেক ভিপি ও নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না।

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি বলেন, ‘ডাকসু তো শুধু ঢাবির গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়। আমি মনে করি, ডাকসু সারাদেশের ছাত্র-ছাত্রীদের অধিকার আদায়, দাবি-দাওয়ার আন্দোলনের বাতিঘর। অনিয়মিত নির্বাচন ও দেশে অগণতান্ত্রিক পরিস্থিতির কারণে ডাকসুর তেজ হারিয়ে গেছে, শিক্ষার্থীরাও ভুলতে বসেছে।’

তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা আসন্ন বা আগামী কয়েকটি ডাকসুতে যদি এমন কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধি পান, যারা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ডাকসুর তেজোদীপ্ত বোধটা জাগিয়ে তুলতে পারবেন, তাহলে আর ডাকসু অনিয়মিত হবে না। ডাকসুকে সক্রিয় রাখতে ছাত্রছাত্রীরাই এগিয়ে আসবে বলে আশা করি।’

এএএইচ/এমএএইচ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।