তুরস্কে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিলের পর কী হয়েছিল?

খান আরাফাত আলী
খান আরাফাত আলী খান আরাফাত আলী , সহ -সম্পাদক
প্রকাশিত: ০১:১৪ পিএম, ২৮ আগস্ট ২০২৫
বিতর্কের কেন্দ্রে ছিল ইস্তাম্বুলের বিখ্যাত আয়া সোফিয়া মসজিদ/ ফাইল ছবি: এএফপি

তুরস্ক বর্তমানে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। তবে এ অবস্থায় পৌঁছানোর পেছনে রয়েছে দেশটির দীর্ঘ রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক ইতিহাস।

উসমানীয় সাম্রাজ্যের সময় থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত তুরস্কে ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে বহাল ছিল। সুলতান তখন শুধু রাজনৈতিক নেতা নন, মুসলিম বিশ্বের খেলাফতেরও প্রধান ছিলেন। রাষ্ট্র পরিচালনায় ইসলামী আইনও কার্যকর ছিল।

১৯২৩ সালে মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে আধুনিক প্রজাতন্ত্র তুরস্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। যদিও প্রজাতন্ত্র ঘোষণার পরও ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে বহাল রাখা হয়, তবে আতাতুর্ক দ্রুত ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কার শুরু করেন।

১৯২৪ সালের সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু চার বছর পর, ১৯২৮ সালে সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বিষয়ক ধারা বাতিল করা হয়। এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো তুরস্ক আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রধর্মহীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়।

আরও পড়ুন>>

পরবর্তীতে ১৯৩৭ সালের সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বা ‘লাইক্লিক’কে সংবিধানের মূলনীতির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা তুরস্ক রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্যতম ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

kemalমোস্তফা কামাল আতাতুর্ক/ ফাইল ছবি: আনাদোলু এজেন্সি

রাষ্ট্রধর্ম বাতিলের পর কী হয়েছিল?

তুরস্কে ১৯২৮ সালে সংবিধান থেকে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে বাতিলের পর মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে প্রজাতন্ত্রী তুরস্ক ধর্মনিরপেক্ষতার পথে এগিয়ে যায়। এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ও ঘটনা ঘটেছিল:

১. ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কার: আতাতুর্কের সংস্কার কর্মসূচির অংশ হিসেবে ধর্মকে রাষ্ট্রীয় শাসন থেকে পৃথক করা হয়। শরিয়া আইন বাতিল করে পশ্চিমা মডেলের সিভিল কোড প্রবর্তন করা হয়, যেমন সুইস সিভিল কোডের ভিত্তিতে নতুন আইন প্রণয়ন। এর ফলে বিয়ে, বিবাহবিচ্ছেদ ও উত্তরাধিকারের মতো বিষয়ে ধর্মীয় আইনের পরিবর্তে ধর্মনিরপেক্ষ আইন কার্যকর হয়।

২. ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ: মসজিদ, মাদরাসা ও ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। ধর্মীয় ভ্রাতৃত্ববোধের সংগঠন (তরিকা) নিষিদ্ধ করা হয়। ডিরেক্টরেট অব রিলিজিয়াস অ্যাফেয়ার্স (দিয়ানেত) প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ইসলামী বিষয়গুলো রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে পরিচালনা করে।

৩. সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিবর্তন: ধর্মীয় প্রভাব কমাতে পোশাক সংস্কার করা হয়। ফেজ টুপি নিষিদ্ধ করে পশ্চিমা ধাঁচের পোশাক প্রচলন করা হয়। আরবি হরফের পরিবর্তে ল্যাটিন বর্ণমালা গ্রহণ করা হয়, যা ধর্মীয় গ্রন্থের প্রভাব কমায়। ধর্মীয় শিক্ষার পরিবর্তে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাকে জোর দেওয়া হয়।

৪. সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া: ধর্মনিরপেক্ষতার এই পদক্ষেপ কিছু ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ও রক্ষণশীল সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধিতা দেখা দেয়। ১৯২০-৩০’র দশকে কিছু বিদ্রোহ, যেমন শেখ সাইদ বিদ্রোহ (১৯২৫), ধর্মীয় ও জাতিগত উত্তেজনার কারণে সংঘটিত হয়। যদিও এগুলো কঠোরভাবে দমন করা হয়।

৫. দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব: ধর্মনিরপেক্ষতা তুরস্কের আধুনিক রাষ্ট্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, ধর্মীয় পরিচয় ও ইসলামের ভূমিকা নিয়ে সমাজে উত্তেজনা অব্যাহত থাকে। পরবর্তীতে, বিশেষ করে ২০০০-এর দশকে এরদোয়ানের নেতৃত্বে ইসলামপন্থি রাজনীতির উত্থানের মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতার কঠোর নীতি কিছুটা শিথিল হয়।

erdoganআয়া সোফিয়ার ভেতরে এরদোয়ান/ ছবি: তুর্কি প্রেসিডেন্টের কার্যালয় (এক্স)

মসজিদগুলোতে নামাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল?

তুরস্কে ১৯২৮ সালে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে বাতিলের পর ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি প্রয়োগের অংশ হিসেবে কিছু উল্লেখযোগ্য মসজিদের ব্যবহারে পরিবর্তন আনা হয়, তবে সব মসজিদে নামাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়নি। বড় বড় মসজিদগুলোর ক্ষেত্রে সরকারের নিয়ন্ত্রণ বাড়ানো হয় এবং কিছু ক্ষেত্রে তাদের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বের কারণে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়।

উদাহরণস্বরূপ, তুরস্কের সর্ববৃহৎ এবং ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা আয়া সোফিয়া ১৯৩৫ সালে মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের নির্দেশে সরকারি জাদুঘরে রূপান্তরিত হয়। এটি মূলত একটি বাইজান্টাইন ক্যাথেড্রাল ছিল (৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত), যা ১৪৫৩ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের ইস্তাম্বুল বিজয়ের পর মসজিদে রূপান্তরিত হয়। ১৯৩৫ সালে জাদুঘরে রূপান্তরের মাধ্যমে এর ধর্মীয় কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং এটি সব ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এই পদক্ষেপ ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। স্থাপনাটি বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ইউনেস্কোর তালিকায়ও অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে, ২০২০ সালে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের নির্দেশে আয়া সোফিয়াকে ফের মসজিদে রূপান্তরিত করা হয়।

হিজাব নিষিদ্ধ হয়েছিল?

তুরস্কে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ধর্মীয় পরিচয়ের মধ্যে দীর্ঘদিনের সংঘাতের প্রতীক এই হিজাব বিতর্ক। মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত আধুনিক তুর্কি প্রজাতন্ত্রে বিভিন্ন সংস্কারের মাধ্যমে ধর্মীয় পোশাক, যেমন- ফেজ টুপি ও হিজাব, সরকারি ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ করা হয়।

hagia sofiaআয়া সোফিয়ার ভেতরে নামাজ পড়ছেন দুই নারী/ ফাইল ছবি: জাগোনিউজ

১৯৮০ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর ১৯৮২ সালের ২৫ অক্টোবর অফিসিয়াল গেজেটে (নম্বর: ১৭৮৪৯) প্রকাশিত পোশাক প্রবিধানে সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নারীদের মাথা খোলা রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়, যা হিজাব পরার ওপর প্রকারান্তরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এই নিষেধাজ্ঞা স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, আদালত এবং সরকারি দপ্তরে কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয়। ১৯৯৭ সালের সামরিক স্মারকলিপির পর এই নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর হয়, যার ফলে হিজাব পরা নারীরা শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হয়। এই নীতি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক বিতর্ক ও প্রতিবাদের জন্ম দেয়।

২০০২ সালে ক্ষমতায় আসা জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একে পার্টি) ধীরে ধীরে ধর্মনিরপেক্ষ নীতির কঠোরতা শিথিল করে। ২০১৩ সালে ‘ডেমোক্রেটাইজেশন প্যাকেজ’-এর মাধ্যমে সরকারি প্রতিষ্ঠানে হিজাবের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। ২০১৪ সালে উচ্চবিদ্যালয় এবং ২০১৭ সালে সশস্ত্র বাহিনীতেও হিজাব পরার অনুমতি দেওয়া হয়।

হজ-ওমরাহ নিষিদ্ধ হয়েছিল?

না, তুরস্কে ১৯২৮ সালে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম বাতিলের পর হজ বা ওমরাহ সরাসরি নিষিদ্ধ করা হয়নি। তবে, মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কারের অংশ হিসেবে ধর্মীয় কার্যক্রমের ওপর কিছু নিয়ন্ত্রণ ও সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়েছিল, যা হজ-ওমরাহর মতো ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের সহজলভ্যতা এবং প্রকাশ্য প্রচারকে প্রভাবিত করেছিল।

ইসলামকে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা থেকে সরিয়ে দেওয়ার আগেই ১৯২৪ সালে তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ সরকার ধর্মীয় কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের জন্য দিয়ানেত ইশলেরি বাশকানলিগি (প্রেসিডেন্সি অফ রিলিজিয়াস অ্যাফেয়ার্স বা দিয়ানেত) প্রতিষ্ঠা করে। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মসজিদ, ধর্মীয় শিক্ষা এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে নিয়ন্ত্রিত হতো।

হজ ও ওমরাহর মতো ধর্মীয় তীর্থযাত্রার জন্য তখন সরকারি অনুমতি এবং সংগঠিত ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন হতো। এছাড়া সংগঠিত তীর্থযাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় ভ্রমণ নথি, অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং সরকারি অনুমোদন পাওয়া কঠিন ছিল। এসব কারণে ১৯২০-এর দশক থেকে ১৯৪০-এর দশক পর্যন্ত তুরস্কে হজযাত্রীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।

পরবর্তীতে, ১৯৫০ সালে আদনান মেন্দেরেসের ডেমোক্রেট পার্টির ক্ষমতায় আসার পর ধর্মনিরপেক্ষ নীতি কিছুটা শিথিল হয়। দিয়ানেত ১৯৭৯ সাল থেকে হজ ও ওমরাহর জন্য সংগঠিত ভ্রমণের দায়িত্ব নেয়, যা বর্তমানে তুরস্কের তীর্থযাত্রীদের জন্য প্রধান ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করে।

তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, আল-জাজিরা, মেভজুয়াত, ডেইলি সাবাহ
কেএএ/

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।