বিশ্বে আরেকটি যুদ্ধ হলে তেলের কী হবে?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১:২৮ পিএম, ০৫ জানুয়ারি ২০২০

২০০৪ সালে ইরাকে যখন দ্বিতীয়বারের মতো যুদ্ধ শুরু হয়, তখন হঠাৎ করেই অপরিশোধিত তেলের দাম রাতারাতি প্রত্যেক ব্যারেলে প্রায় ১০ মার্কিন ডলার বৃদ্ধি পায়। সেই সময় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী যাদের কাছে স্বল্প পরিমাণে তেল মজুত ছিল, রাতারাতি তারাও প্রচুর মুনাফা বাগিয়ে নেন।

মিচ খান যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের মার্কেন্টাইল এক্সচেঞ্জের ভেসি স্ট্রিটের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। ম্যানহাটনের এই ব্যবসায়ী ইরাক যুদ্ধের সময় হঠাৎ তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রত্যক্ষদর্শী। ম্যানহাটনের ভেসি স্ট্রিটের মার্কেটে নিচ তলায় অপরিশোধিত তেল, গ্যাস এবং ওপরের তলায় মূল্যবান ধাতব পদার্থ কেনাবেচা হয়।

২০০৪ সালে ইরাকে যখন যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে তখন ভেসি স্ট্রিটে ক্রেতা-বিক্রেতারা প্রকাশ্যে দরকষাকষি করে তেল, গ্যাসের দাম নির্ধারণ করতেন। এ সময় বিক্রেতারা নিলামে তোলার মতো চিৎকার করে তেল, গ্যাসের দাম বলতেন। অনেকে কিনতেন, অনেকে বেচতেন। বিক্রেতা-ক্রেতার প্রকাশ্য দরকষাকষির মাধ্যমে এভাবে তেল, গ্যাস বিক্রি হতো সেখানে।

প্রথম ২৪ ঘণ্টায় প্রচুর পরিমাণে তেল, গ্যাস বিক্রি হলো এ বাজারে। পরদিন মার্কেট খোলার পর একই ভাবে বিক্রেতারা চিৎকার করে দাম হাঁকাতে থাকলেন। নিউইয়র্কের ওই ব্যবসায়ী এখনও মনে করতে পারেন, পরদিন আর বাজার আগের দিনের মতো হলো না। তার পাশের ব্যবসায়ীরা কিছু তেল বিক্রির চেষ্টা করলেন; কিন্তু পারলেন না। কারণ তেলের বাজারে ধস।

kasem-1

কয়েক মিনিটের মধ্যে এক ব্যারেল তেলের দাম ২০ ডলার কমে গেল। তবে আজকের দিনে তা হওয়ার সম্ভাবনা কম। ভেসি স্ট্রিটের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী খান বলেন, এখন বাজার ভিন্নভাবে চলে। গত শুক্রবার বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়লেও সর্বশেষ ইরাক যুদ্ধকালীন তেলের বাজারের সঙ্গে বর্তমানের বাজারের সবকিছুই ভিন্ন বলে মনে করেন তিনি। উৎপাদন, পরিশোধন ও বাজারজাতের সঙ্গে এখন তেলের দামের কোনো মিল নেই।

গত শুক্রবার বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত ব্রেন্টের দাম ৪ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এক ব্যারেল অপরিশোধিত ব্রেন্টের দাম এখন সাড়ে ৬৯ ডলারে পৌঁছেছে। গত শুক্রবার বাগদাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে মার্কিন ড্রোন হামলায় ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর অভিজাত শাখা কুদস ফোর্সের প্রধান কাসেম সোলেইমানি নিহত হওয়ার পর তেলের মূল্যবৃদ্ধি পায়। পেন্টাগন তেহরানের এই সামরিক কর্মকর্তা হত্যার ঘটনাকে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসেবে দাবি করেছে।

ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনায় ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম এবং রয়্যাল ডাচ শেলের শেয়ারের দাম প্রায় দেড় শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যাংক অব আমেরিকার পণ্য-সামগ্রী কৌশলবিদ মাইকেল ওয়াইডমার বলেন, ২০০৪ সালের সঙ্গে এখনকার তেলের বাজারে সবচেয়ে বড় পরিবর্তনকারী যে একক ফ্যাক্টরটি কাজ করছে, সেটি হলো যুক্তরাষ্ট্র পর্যাপ্ত পরিমাণে তেল মজুত করেছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন আর মধ্যপ্রাচ্যের অপরিশোধিত তেলের ওপর নির্ভর করে না। অতীতের রীতি আসলেই পরিবর্তন হয়েছে।

গত সেপ্টেম্বরে সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তেল প্ল্যান্টে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের ড্রোন হামলার ঘটনা এর ভালো উদাহরণ। তিনি বলেন, সেটাই ছিল এ পর্যন্ত বিশ্ববাজারে তেল সরবরাহের ক্ষেত্রে বৃহত্তম আঘাত। তবে এতে বিশ্ববাজারে স্থায়ী কোনো প্রভাব পড়েনি। হামলার দিন বাজারে তেলের দাম প্রতি ব্যারেলে ১০ ডলার বাড়লেও পরে সেটি স্বাভাবিক হয়ে যায়।

Kasem

সেই সময় ইরান এবং যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র বাগবিতণ্ডা ও তেহরানের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দেয় ওয়াশিংটন। যুক্তরাষ্ট্রের এ ঘোষণার ১৫ দিন পরই প্রতি ব্যারেল তেলের দাম কমে ৬০ ডলারে ঠেকে। কিন্তু বর্তমানে রাজনৈতিক বাগবিতণ্ডা ও উত্তেজনায় তেলের দাম ওঠা-নামা করতে পারে। এর কারণ আরও অনেক দেশ বিশেষ করে রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র এখন বিশ্ববাজারে তেল সরবরাহ করছে।

বিশ্বের জ্বালানি তেলের রফতানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ওপেক। সংগঠনটি বিশ্ববাজারে তেল সরবরাহের বেশিরভাগ নিয়ন্ত্রণ করতো। সংগঠনটি এখন আর আগের মতো নেই। মাইকেল ওয়াইডমার বলেন, ওপেক তেলের উৎপাদন কমিয়ে দিলে তা অন্য দেশগুলোর উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সুযোগ তৈরি করে।

উড ম্যাকেঞ্জি বিপণন ও গবেষণা দলের প্রধান অ্যালান গেলডার বলেন, ওপেক এক সময় বিশ্বের অর্ধেক তেল উৎপাদন করতো। কিন্তু বর্তমানে তা এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে। ১৯৯০ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় বিশ্বে তেল আসতো দুটি জায়গা থেকে। তখন তেল আসতো ওপেক থেকে অথবা তেল উৎপাদনের জন্য ব্যয়বহুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে পরিচিত উত্তর সাগর থেকে।

গেলডার বলেন, ৪০ বছর আগে তেলের সন্ধান এবং সাগর থেকে উত্তোলন ছিল অনিশ্চিত এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। তখন সবেমাত্র পণ্যসামগ্রীর বাজার স্থিতিশীল হতে শুরু করেছে। কিন্তু এখন বাজারে আরও অনেক অংশীদার। তিনি বলেন, পাঁচ বছর আগের তুলনায় এখন সহজেই আরও বেশি তথ্য পাওয়া যায়।

iran

সৌদি আরবের তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে গত সেপ্টেম্বরে যখন হামলা হয়, তখন স্যাটেলাইটে পাওয়া ছবিতে দেখা যায়, ওই প্ল্যান্টে দ্রুতই তেলের উৎপাদন শুরু হয়েছে। সেখান থেকে তেল নিয়ে বন্দর ছাড়ছে জাহাজগুলো।

গেলডার বলেন, অতীতে এ ধরনের ঘটনার পর কী ঘটছে সেটা জানার জন্য একে অপরের সঙ্গে আলাপ আলোচনা ও জানার চেষ্টা করতো। কিন্তু এখন মুহূর্তের মধ্যেই যেকোনো বিষয়ে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সঙ্কটকালীন সেই মুহূর্তে ওপেক এবং রাশিয়ার মতো দেশগুলো তেলের উৎপাদন বেশি করতে রাজি হয়।

যে কারণে মধ্যপ্রাচ্যের ক্রমবর্ধমান উত্তেজনায় যদি বিশ্বে আরেকটি যুদ্ধ শুরু হয় তাহলে তেলের দামে কী ঘটবে সেটি বিশেষভাবে জানা কঠিন হয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর ইরানের পাল্টা প্রতিশোধের আশঙ্কায় তেলের দাম সাময়িক বাড়তে পারে বলে ধারণা করছেন যুক্তরাষ্ট্রের সিটিব্যাংকের বিশ্লেষকরা।

তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের তেল কোম্পানির পাইপলাইনে কিংবা নতুন তেলক্ষেত্র অনুসন্ধানের জন্য পশ্চিমা বিশ্ব অথবা মার্কিন তেল কোম্পানির বিনিয়োগের ওপর যদি হামলা হয়, তাহলে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি পেতে পারে। ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনা প্রশমনে কোনো ধরনের সমাধান হয়ে গেলে তেলের দাম কমে যাবে।

সূত্র : বিবিসি।

এসআইএস/পিআর

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।