মধ্যপ্রাচ্যে রণ দামামা

আনিস আলমগীর
আনিস আলমগীর আনিস আলমগীর , সাংবাদিক ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: ১০:১৯ এএম, ০৯ জানুয়ারি ২০২০

গত ৩ জানুয়ারি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইরানের জেনারেল কাসেম সোলেইমানি নিহত হওয়ার পর বিশ্বপরিস্থিতি উত্তেজনাকর পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। ইরান আর আমেরিকার পাল্টাপাল্টি হুমকির মুখে ইরাকে অবস্থিত দুটি মার্কিন বিমান ঘাঁটিতে ইরান এক ডজনের বেশি ব্যালিস্টিক মিসাইল হামলা চালিয়েছে। সোলেইমানিকে দাফনের একটু আগেই ইরানের স্থানীয় সময় ৮ জানুয়ারি রাত দেড়টার দিকে (বাংলাদেশ সময় ভোর সাড়ে ৪টায়) এই হামলা শুরু হয়। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে বলা হয়েছে, সোলেইমানিকে ড্রোন হামলায় হত্যার জবাব হিসেবে এই হামলা করা হয়েছে। তারা এই অভিযানের নাম দিয়েছে ‘অপারেশন শহীদ সোলেইমানি’।

যুক্তরাষ্ট্রের পাঁচ হাজারের মতো সৈন্য রয়েছে ইরাকে। ইরাকের সেনাবাহিনী বলেছে, তাদের সৈন্যদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। আমেরিকাও প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় তাই বলছে। তবে ইরান দাবি করছে ৮০ জন আমেরিকান সৈন্য নিহত হয়েছে এতে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বলেছেন, ইরাকে মার্কিন ঘাঁটিতে হামলার মাধ্যমে তারা আমেরিকার ‘মুখে চপেটাঘাত’ করেছেন।

ইরাক বলেছে, ইরান থেকে ২২টি মিসাইল ছোড়া হয়েছিল। আল আসাদ ঘাঁটিতে ১৭টি মিসাইল হামলা চালানো হয়। এর মধ্যে দুটি মিসাইল বিস্ফোরিত হয়নি। তবে ইরবিলে যে পাঁচটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে তার সবগুলো লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করেছে। মার্কিন হামলায় ইরানি জেনারেল সোলেইমানি নিহত হওয়ার পর ইরাকের পার্লামেন্ট দেশটি থেকে মার্কিন সৈন্যদের সরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। কানাডা, জার্মানি ইরাক থেকে তার সেনা প্রত্যাহারে ঘোষণা দিয়েছে। তবে আমেরিকা বলেছে, ইরাক থেকে সরে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনাই তাদের নেই। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এও বলেছেন যে, ইরাক থেকে যদি মার্কিন সৈন্যদের চলে যেতে হয় তাহলে দেশটির ওপর এমন অবরোধ আরোপ করা হবে, যা ইরাক ‘আগে কখনো দেখেনি’।

এ রকম ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে পরিস্থিতি কোনো দিকে যায় তা নিয়ে উদ্বিগ্ন বিশ্ববাসী। মার্কিন সেনাদের ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালানোর পর দুই পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, জার্মানি, জাপান, ইউএই, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান, ভারত, ইরাক, নিউল্যিান্ডস, পোলান্ড, ফিলিপাইনসহ অন্যান্যরা। ইরান এর সঙ্গে হুঁশিয়ারি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র যদি কোনো পাল্টা হামলা চালায় তার পরিণতিতে ইরান ওই এলাকায় যু্ক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের ওপর হামলা চালাবে। এর আগে ট্রাম্প বলেছিলেন, ইরান প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করলে ইরানের ৫২টি টার্গেটে আমেরিকা হামলা চালাবে। ইরান বলেছিল আমেরিকার ৩৫টি স্পটকে টার্গেট হিসেবে স্থির করেছে তারা। তাদের এই টার্গেটের মধ্যে ইসরাইলও রয়েছে।

পরিস্থিতি যা বোঝা যাচ্ছে, তাতে মনে হয় ইরাক-মার্কিন যুদ্ধ যদি বেঁধে যায় তবে তা মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। আমেরিকার সঙ্গে ইরানের কোনো কনভেনশনাল যুদ্ধ হবে বলেও মনে হয় না। এ রকম খণ্ড খণ্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে ইরান প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করবে। প্রাচীনকালের রোম আর পারস্য ছিল দুই বিরাট সাম্রাজ্য। তারাই সেই সময়ের সুপার পাওয়ার। ইসলামের উত্থানের পর এই দুই সাম্রাজ্যের বিনাশ হয়েছে। তবে ইরানিদের প্রাচীন মেজাজ এখনও বিদ্যমান। তুর্কি খেলাফতের যৌবনকালেও তারা ইরানকে গ্রাস করতে পারেনি। ইরান তার স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা নিয়ে টিকেছিল।

ট্রাম্প মোটাবুদ্ধির মানুষ। অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে ইরানি জেনারেলকে হত্যা করে দুনিয়ার পরিস্থিতি ঘোলাটে করে দিলেন। কাসেম সোলেইমানি ইরানের একজন শ্রেষ্ঠ সমরনায়ক। আয়াতুল্লাহ খামেনির পর রাষ্ট্রের দ্বিতীয় পাওয়ারফুল ব্যক্তি হিসেবে ধরা হতো তাকে। তার জানাজায় শরিক হওয়া জনতার ঢল দেখে ট্রাম্প বুঝতে পারছেন কিনা জানি না, সোলেইমানি কতটা জনপ্রিয় এবং আমেরিকাকে ইরান এখনও কতটা ঘৃণা করে। ট্রাম্পের হামলায় ইরানের কট্টরপন্থীরা আরও মজবুত হয়েছে এবং জাতীয় জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। অভ্যন্তরীণ যে মতবিরোধ এবং সরকারবিরোধী ক্ষোভ ছিল- তাও আপতত ধামাচাপা পড়ে গেছে।

যে কাজ বুশ করেননি, ওবামা করেননি- তা ট্রাম্প করতে গিয়ে বিশ্বের শান্তি স্থিতিশীলতা অনিশ্চিত করে তুলেছেন। আমি বলছি না যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দেবে। রাশিয়া আর চীন অংশগ্রহণ না করলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হতে পারে না। তবে ক্ষুদ্র ঘটনা যেকোনো বৃহৎ ঘটনার জন্ম দিতে পারে- এটাও সত্য।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল তাও একটা হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে। অস্ট্রিয়ার রাজপুত্র ফ্রাঞ্জ ফারডিনান্দ বসনিয়া-হার্জেগোভিনা সফরে গেলে ১৯১৪ সালের ২৮ জুন সারাজেভোয় আততায়ীর হাতে নিহত হন। সেই ক্ষুদ্র একটি ঘটনা থেকে দুই পক্ষের যুদ্ধের সূচনা হয়। বড় দেশগুলো পক্ষে-বিপক্ষে অংশ নিলে শেষ পর্যন্ত পাঁচ বছরব্যাপী একটা যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। সুতরাং ছোট দ্বিপক্ষীয় ঘটনাকেও উপেক্ষা করা যায় না। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁর সঙ্গে ফোনে আলাপ করেছেন। জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মের্কেলকে রাশিয়ায় আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। বড় বড় রাষ্ট্রগুলো এই বিষয়ের প্রতি মাথা দেয়া উচিত, যেন উভয়ের পাল্টাপাল্টি ব্যবস্থা গ্রহণের কারণে পরিস্থিতির অবনতি না ঘটে।

চীন তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছে, শক্তির রাজনীতি জনপ্রিয় বা টেকসই হয় না। তারা ট্রাম্পকে আহ্বান জানিয়েছেন আমেরিকার শক্তির অপব্যবহার না করার এবং পরিস্থিতির আরও অবনতি যাতে না ঘটে তার জন্য সংযম প্রদর্শনের। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফের সঙ্গে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই-এর ফোনালাপ হয়েছে। চীন ইরানকে তাদের সমর্থনের কথা ব্যক্ত করেছে।

আমেরিকাতেও ট্রাম্পের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে। সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ডিনামাইট ছুড়লেন ট্রাম্প। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প একজন অদ্ভুত গোঁড়া এবং পুরোনো ধ্যানধারণায় বিশ্বাসী লোক। তার নিও নাৎসি চিন্তায় রাষ্ট্রসংঘ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোনো জায়গা নেই। জাতিসংঘের অর্থসাহায্য কমানোর কথা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ন্যাটো অপ্রাসঙ্গিক এ কথা বলে তিনি পিছিয়ে আসছেন প্রগতিবাদী বিশ্বব্যবস্থা থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যে সম্মিলিত অস্তিত্বের লক্ষ্য নিয়ে পৃথিবী এগোতে শুরু করেছিল তার থেকে আমেরিকাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার এক অদ্ভুত প্রয়াসে মেতে উঠেছেন ট্রাম্প। তার এই কর্মকাণ্ড বিশ্বব্যবস্থাকে আঘাত করবে এবং ধীরে ধীরে সারাবিশ্বব্যাপী এক সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।

অবশ্য প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি ট্রাম্পের সমরক্ষমতা টেনে ধরার কথা বলেছেন। তবে সিনেট যদি সহযোগিতা না করে তা কখনো সম্ভব হবে না। কারণ তাদের শাসনতন্ত্র প্রতিনিধি পরিষদের হাতে এমন কোনো ক্ষমতা দেয়নি। তবে কংগ্রেস ইচ্ছে করলে তা করতে পারে। নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদ এবং উচ্চকক্ষ সিনেট নিয়েই মার্কিন কংগ্রেস।

রোববার (৫ জানুয়ারি) রাতে ইরানের মন্ত্রিসভা বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইরান পরমাণু উপকরণ সমৃদ্ধিকরণ, মজুত, গবেষণা ও উন্নয়নের কাজে আর কোনো বাধা-নিষেধ বা সীমাবদ্ধতা মানবে না। তবে ইরানের পক্ষ থেকে পারমাণবিক আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের প্রতি সহযোগিতা প্রদান অব্যাহত রাখার কথা বলা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরমাণু উপকরণ সমৃদ্ধ করে বোমা বানাতে ইরানের এক বছরের ওপর লাগবে না।

ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী সাধারণ পরিষদে বক্তৃতায় বলেছিলেন যে তার দেশের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের রিপোর্ট অনুসারে ইরান পারমাণবিক বোমা বানিয়েছে এবং ইরানের কাছে বোমার মজুতও রয়েছে। আমেরিকার মতে, ইরানের কাছে ২০ হাজার সেন্ট্রিফিউজ ইউরেনিয়াম রয়েছে যা দিয়ে ১০টি পরমাণু বোমা তিন মাসের মধ্যে বানানো সম্ভব। এখন ইসরাইল এবং আমেরিকা ইরানের পরমাণু কেন্দ্র ধ্বংস করার জোর প্রচেষ্টা চালাবে।

ইরান-আমেরিকা সমস্যা নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক হচ্ছে ব্রাসেলসে। আবার ফ্রান্স-জার্মানি আর যুক্তরাজ্যের মধ্যে বৈঠক হচ্ছে। এই বৈঠকে চীন-রাশিয়াকে আমন্ত্রণ জানালেও উত্তম হতো। গত চার দশকব্যাপী ইরানের ওপর কঠিন বাণিজ্যিক অবরোধ চলছে। তা প্রত্যাহারের শর্তে ২০১৫ সালে ইরান ছয় জাতির সঙ্গে আলোচনা করে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কাজ বন্ধ করেছিল। এখন আমেরিকার কেউ-কেউ বাণিজ্যিক অবরোধ সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের কথা বলছেন। এ বিষয়ে একটি সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছালে হয়তো ইরান-আমেরিকার উদ্ভূত পরিস্থিতি সমাধানের মুখ দেখবে এমন একটি ইঙ্গিত ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও দিয়েছেন।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]

এইচআর/বিএ/জেআইএম

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।