মার্টিন লুথার কিংয়ের ‘স্বপ্ন’ থেকে তারেক রহমানের ‘পরিকল্পনা’
দীর্ঘ ১৭ বছরের নির্বাসন শেষে বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখে প্রথম জনসভাতেই চমক দিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বৃহস্পতিবার (২৫ ডিসেম্বর) রাজধানীর পূর্বাচলে আয়োজিত গণসংবর্ধনায় লাখো জনতার উদ্দেশে তিনি বিশ্বখ্যাত কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের ঐতিহাসিক উক্তি ‘I Have a Dream’ (আই হ্যাভ আ ড্রিম)-এর প্রসঙ্গ টেনে ঘোষণা করেন, ‘I Have a Plan’ (আই হ্যাভ আ প্ল্যান)।
তার এই বক্তব্য কেবল জনসভাতেই নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং দেশের মূলধারার গণমাধ্যমেও এক নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
কে ছিলেন মার্টিন লুথার কিং?
মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের একজন ব্যাপটিস্ট ধর্মযাজক এবং নাগরিক অধিকার আন্দোলনের (Civil Rights Movement) অবিসংবাদিত নেতা। যিনি ১৯২৯ সালের ১৫ জানুয়ারি, আটলান্টা, যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলনে বিশ্বাসী ছিলেন। ১৯৬৪ সালে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬৮ সালের ৪ এপ্রিল আততায়ীর গুলিতে নিহত হন এই মহান নেতা।

‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’ উক্তিটি কখন করা হয়েছিল?
১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে প্রায় আড়াই লাখ মানুষের সামনে এই ঐতিহাসিক ভাষণটি দেন মার্টিন লুথার কিং। সেই ভাষণে তিনি বলেছিলেন, আমার একটি স্বপ্ন আছে যে, আমার চার সন্তান এমন এক দেশে বাস করবে যেখানে তাদের গায়ের রং দিয়ে নয়, তাদের চরিত্রের গুণাবলি দিয়ে বিচার করা হবে।
এই ভাষণটি বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে বিশ্ব ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।
তারেক রহমানের কণ্ঠে এমন উক্তি কেন?
তারেক রহমান তার বক্তব্যে বলেন, মার্টিন লুথারের যেমন স্বপ্ন ছিল, তেমনি বাংলাদেশের মানুষ ও দেশের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য তার এবং বিএনপির একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আছে।
ধারণা করা হচ্ছে, তারেক রহমানের ‘আই হ্যাভ আ প্ল্যান’ বলতে মূলত রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফা নির্দেশ করছে। যা হলো বিএনপির একটি আধুনিক ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ। এর মূল লক্ষ্য হলো রাষ্ট্রের বিদ্যমান কাঠামোর আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে একটি জবাবদিহিমূলক শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা।
আরও পড়ুন
লাল-সবুজ বাসে গণসংবর্ধনা মঞ্চের পথে তারেক রহমান
৮ মাস পর মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন তারেক রহমান
এই পরিকল্পনার প্রধান দিকগুলো হলো- কোনো ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না, জাতীয় সংসদে বিশিষ্টজনদের নিয়ে একটি ‘উচ্চকক্ষ’ গঠন করা হবে এবং ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার সমন্বয় করা হবে। এছাড়া অবাধ নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা, প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ করে ‘রেইনবো নেশন’ গঠন এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা এই প্ল্যানের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
সামাজিক সুরক্ষায় প্রতিটি পরিবারের জন্য ‘ফ্যামিলি কার্ড’ এবং সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ‘হেলথ কার্ড’ চালুর মাধ্যমে জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে এই ৩১ দফায়।
সংক্ষেপে, এটি কেবল ক্ষমতার পরিবর্তন নয়। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ও কাঠামোগত সংস্কারের একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা।
বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, টেকসই গণতন্ত্র ও রাষ্ট্র কাঠামোর আমূল পরিবর্তনের লক্ষ্যে তারেক রহমান ঘোষিত ৩১ দফা রূপরেখা মূলত সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ভিশন ২০৩০ এর একটি আধুনিক ও পরিমার্জিত সংস্করণ।

সংবাদমাধ্যমে যেভাবে প্রচার হচ্ছে
সংবাদমাধ্যমগুলো তারেক রহমানের এই বক্তব্যকে কেবল একটি স্লোগান নয়, বরং আগামীর রাষ্ট্র পরিচালনার ‘ভিশন’ হিসেবে দেখছে। গণমাধ্যমগুলো তার এই বক্তব্যকে ‘দেশবাসীর প্রতি সহযোগিতার আহ্বান’ হিসেবে তুলে ধরেছে।
অনেক বিশ্লেষক বলছেন, মার্টিন লুথারের আন্দোলনের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার একটি মিল খোঁজার চেষ্টা করেছেন তারেক রহমান।
ভাষণের শেষে তারেক রহমান আরও যোগ করেন, উই হ্যাভ আ প্ল্যান (আমাদের একটি পরিকল্পনা আছে)। এটি মূলত তার একার নয়, বরং পুরো দল ও দেশবাসীর সম্মিলিত যাত্রার ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বোদ্ধারা।
অনেকে বলছেন তারেক রহমানের এই রেফারেন্স দেওয়ার মূল কারণ হলো- স্বপ্ন দেখা অনেক সময় ব্যক্তিগত হতে পারে, কিন্তু সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে প্রয়োজন একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বা রোডম্যাপ। তিনি মূলত বোঝাতে চেয়েছেন যে, বিএনপি এখন কেবল ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে না। রাষ্ট্র সংস্কারের একটি সুসংগঠিত পরিকল্পনা নিয়েই মাঠে নেমেছে তারা।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে যেভাবে প্রচার হচ্ছে
তারেক রহমানের দেশে ফেরা এবং তার ‘আই হ্যাভ আ প্ল্যান’ বক্তব্যটি নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, বিশেষ করে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে। সেখানে বিষয়টিকে বেশ বিশ্লেষণাত্মক এবং কিছুটা সমালোচনামূলক দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে।
ভারতের প্রভাবশালী বাংলা ভাষার গণমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকা তাদের এবিপি লাইভে (ABP Live) এই বক্তব্যকে ঘিরে বিশেষ বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে।
আনন্দবাজার তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, তারেক রহমান কেবল আমেরিকার বর্ণবৈষম্য বিরোধী নেতা মার্টিন লুথার কিং এর ‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’ ভাষণের প্রসঙ্গই টানেননি। তার এই ‘পরিকল্পনা’র সঙ্গে সদ্য শহীদ জুলাই আন্দোলনের মুখ শফিক ওসমান হাদির আকাঙ্ক্ষাকেও যুক্ত করেছেন।
এবিপি লাইভ তাদের প্রতিবেদনে তারেক রহমানের এই বক্তব্যকে কিছুটা ‘বিতর্কিত’ কিন্তু ‘প্রভাবশালী’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। তারা বলছে, শেখ হাসিনাবিহীন বাংলাদেশে তারেক রহমান নিজেকে একজন শক্তিশালী বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করছেন।
প্রতিবেদনে বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে, তারেক রহমান তার ‘প্ল্যান’ এর অংশ হিসেবে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেছেন।
ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থা রয়টার্স তারেক রহমানকে বাংলাদেশের ‘সম্ভাব্য পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে অভিহিত করেছে। তারা উল্লেখ করেছে যে, তার এই প্রত্যাবর্তন আগামী নির্বাচনের আগে বিএনপির শক্তির মহড়া।
ভারতের এনডিটিভি সংবাদমাধ্যমটি একটি ফিচারে লিখেছে, ‘জিয়ার ছেলের প্রত্যাবর্তন: বাংলাদেশের জন্য তারেক রহমানের গেম প্ল্যান’। সেখানে তার শাসন কাঠামো এবং পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলা হয়েছে।
বিবিসি তাদের প্রতিবেদনে বিএনপির ব্যাপক প্রস্তুতির কথা উল্লেখ করে বলছে, তারেক রহমান তার দীর্ঘ নির্বাসনের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান দিয়ে একটি ‘অ্যাকাউন্টেবল’ বা জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ার পরিকল্পনা দিয়েছেন।
এমডিএএ/এএমএ/জেআইএম