ক্লাসরুম থেকে কফিন: জীবনে-মরণে একসঙ্গে তিন বন্ধু
গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে মো. আশিকুর রহমান উমাইরকে (১০) মৃত ঘোষণা করা হয় সোমবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে। মরদেহ বাড়িতে এনে দাফনের প্রস্তুতির মধ্যেই (দিনগত রাত ৩টা ৪০ মিনিটে) খবর আসে মাহিদ হাসান আরিয়ানও (১১) নেই। আর মঙ্গলবার সকালেই নিশ্চিত হওয়া যায়, বাপ্পি সরকারও (১০) আর শ্বাস নিচ্ছে না।
শেষমেশ মঙ্গলবার (২২ জুলাই) বাদ জোহর তিন শিশুকে একসঙ্গে দাফন করা হয় পারিবারিক কবরস্থানে। মাত্র ১২ ঘণ্টার মধ্যে একই বংশের তিন শিশুকে হারায় দিয়াবাড়ির তারারটেক মসজিদপাড়ার তিন পরিবার।
মাইলস্টোন স্কুল থেকে কয়েক মিনিট দূরত্বের এ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এক উঠোনে পাশাপাশি তিনটি নতুন কবর। এই তিন শিশু একই বংশের। সম্পর্কে চাচা-ভাতিজা। তবে তাদের সবচেয়ে বড় পরিচয়—তারা বন্ধু।
এক উঠোনে একসঙ্গে বেড়ে ওঠা এই তিন শিশু পড়তো মাইলস্টোন স্কুলের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে। কিন্তু সোমবার স্কুলটিতে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় শৈশবেই থেমে গেলো তাদের জীবন।

সরেজমিনে ওই পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, শোকে মুহ্যমান পুরো এলাকা। কবরগুলোর ঠিক উল্টো পাশের ভবনটিই তারারটেক মসজিদ। সেটার বারান্দায় রাখা লাশ বহনকারী খাটিয়া। তার আশপাশে কয়েকজন চাপা স্বরে কথা বলছিলেন। দু-একজন মিডিয়াকর্মীর আসা-যাওয়াও দেখা গেলো।
আরও পড়ুন
- ‘মেয়ের পর ছেলেও চলে গেলো, আমি এখন কী নিয়ে বাঁচবো’
- ‘আমরা টিচার, রাজনীতিবিদ নই’: লাশ গুম ইস্যুতে মাইলস্টোনের শিক্ষক
- মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি: প্রস্তুতির শূন্যতায় হারালাম শিশুর হাসি
সেখানেই কথা হয় মাহিদ হাসান আরিয়ানের আপন চাচাতো ভাই মো. রাসেলের সঙ্গে। রাসেল বলেন, ‘প্রতিদিনের মতো সোমবার সকালেও তিনজন একসঙ্গে স্কুলে গিয়েছিল। কিন্তু ফেরা হয়নি। একের পর এক লাশ হয়ে ফিরে এসেছে আমাদের বাচ্চারা।’
‘তারা একসঙ্গেই খেলতো। একসঙ্গেই তাদের জানাজা হলো, একসঙ্গেই কবর হলো,’ বলেন রাসেল।
তিনি বলেন, ‘স্কুল শেষ হওয়ার পরে তারা কোচিং করতো। তারপর বাসায় আসতো। স্কুল আর কোচিংয়ের এক ফাঁকে এদের একজনের মা গিয়ে সবাইকে খাবার দিয়ে এসেছিল। দেড়টা বাজলে পরিবারের একজন গিয়ে তাদের নিয়েও আসার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই ঘটে যায় সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা।’
রাসেল জানান, তিন শিশুর বাবা-মা কেউ কথা বলার মতো অবস্থায় নেই।
এছাড়া মো. জুনায়েদ (১০) নামে যে শিশুটি মারা গেছে সেও তার মামাতো ভাই বলে জানান রাসেল। সেও তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র ছিল।
রাসেল জানান, নিহত শিশুদের মধ্যে আশিকুর রহমান উমাইর কুতুবের ছেলে। মাইলস্টোন স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়তো। একই শ্রেণিতে পড়তো কুতুবের চাচা মো. সেলিমের ছেলে মাহমুদুল ইসলাম আরিয়ান। আর কুতুবের ফুপাতো ভাই মো. শাহীন সরকারের ছেলে মো. বাপ্পি সরকার পড়তো তৃতীয় শ্রেণিতে।
সেদিনের বর্ণনা দিয়ে রাসেল বলেন, ‘আমি বাড়িতেই ছিলাম। হঠাৎ বিকট আওয়াজ শুনে দৌড়িয়ে বের হয়ে গিয়ে দেখি উমাইর আর বাপ্পি স্কুলের পাশেই মাঠে পড়ে আছে। সেনাবাহিনী তাদের নিয়ে যাচ্ছে।’

আরিয়ানসহ তিনজনকে প্রথমে উত্তরার লুবানা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে সেখান থেকে নেওয়া হয় গুলশান ইউনাইটেড হাসপাতালে। সেখানেই মারা যায় উমাইর। আর বাপ্পিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে।
রাসেল বলেন, ‘আমরা আরিয়ানের মরদেহ নিয়ে বাসায় আসি। তার এক ফুফু চীনে থাকেন। সিদ্ধান্ত হয় তিনি ফিরলে দাফন হবে। সেভাবেই রাখা হয়। কিন্তু রাত ৩টা ৪০ মিনিটে আরেক চাচাতো ভাই ফোন দিয়ে বলে আমাদের সেলিম চাচার ছেলে আরিয়ান মারা গেছে। তার মরদেহ বাড়িতে না আনতেই খবর আসে বাপ্পিও আর নেই।’
এর আগে নিহত বাপ্পির বাবা মোহাম্মদ আবু শাহিন গণমাধ্যমকে জানান, জোহরের নামাজ শেষ করে বাপ্পি, আরিয়ান ও উমাইরকে আনতে স্কুলে যাচ্ছিলেন তিনি। বিকট শব্দ শুনে দৌড়ে স্কুলে পৌঁছান।
আবু শাহিন বলেন, গিয়ে দেখি আমার ছেলের ক্লাসরুমের পাশের রুমটাতেই বিমানটি ঢুকে গেছে। বিপদ বুঝতে পারি। তবু আমার ছেলে, ভাতিজা ও চাচাতো ভাইকে খুঁজতে থাকি। একসময় পেয়েও যাই সবাইকে। তবে আমার ছেলে ও ভাতিজাকে জীবিত পেলেও চাচাতো ভাই আরিয়ানকে পেয়ে বুঝতে পারি সে আর নেই।’
এক প্রতিবেশী জানান, জ্বরে ভোগার কারণে এক মাস স্কুলে যায়নি আরিয়ান। ঠিক একমাস পর যেদিন স্কুলে গেলো, সেদিনই বিমান দুর্ঘটনায় সে প্রাণ হারালো।
সোমবার দুপুরে বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান ঢাকার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বিধ্বস্ত হয়। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ২৯ জনের। আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন ৬৯ জন।
জেপিআই/এএসএ/ এমএফএ/এমএস