উত্তরায় বিমান বিধ্বস্ত
শিশুদের কফিন যেন আর দেখতে না হয়

প্রাইমারি শাখার ক্লাস ছুটি হবে হয়তো আর মিনিট দশেক পরই, এরই মধ্যে হুড়মুড়িয়ে আকাশ থেকে নামলো আগুন! সে আগুন চোখের পলকে খেয়ে ফেললো তাজা তাজা প্রাণ! আহ! কী বিভীষিকাময় দিন ২১ জুলাই, ২০২৫! যা বাংলাদেশ তথা রাজধানী ঢাকার উত্তরার মানুষের মনে দীর্ঘকাল আতঙ্ক ও শোকের ছাপ ফেলে রাখবে। উত্তরা মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজের ছাদে একটি যুদ্ধবিমান (যেটি প্রশিক্ষণের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছিল) বিধ্বস্ত হয়। মুহূর্তেই আগুনের লেলিহান শিখা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। প্রাণ হারায় ৩১ জন। যার বেশিরভাগই শিশু। আহত শত শত- শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থী।
মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি; এটি কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটি রাষ্ট্রের অবহেলার ফল এবং এই রক্তাক্ত দিনটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার কতটা ভয়াবহ ফাঁক রয়েছে। কারণ বিদ্যালয়ে শিশুমৃত্যু কেবল সংখ্যাতত্ত্ব নয়, এটা গোটা জাতির চেতনার মৃত্যু!
একটি শিশু হারানো মানে একটি ভবিষ্যৎ জাতি হারানো। এত সংখ্যক শিশুর মৃত্যু শুধু অব্যবস্থাপনার কারণে। একটি স্কুলের এত কাছ দিয়ে বারবার প্রশিক্ষণ বিমান উড়ে যাবে—এই অনুমোদন কে দিল? অথবা বিমান চলাচল করে-এমন এলাকায় স্কুলের অনুমোদনও বা কীভাবে হলো? কে এই ভুল সিদ্ধান্তের দায় নেবে? এই প্রশ্নগুলো এখন কেবল সাংবাদিক বা পরিবার নয়, গোটা জাতির জিজ্ঞাসা হয়ে দাঁড়িয়েছে– বিমান প্রশিক্ষণ নাগরিক এলাকাজুড়ে কেন?
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে দেখা গেছে—নিরাপত্তা কিংবা প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে নিয়মনীতি অনেক সময় কাগজেই থাকে। বাস্তবায়নে থাকে শৈথিল্য, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এবং অদৃশ্য সুবিধার সমঝোতা। তা না হলে প্রশিক্ষণ বিমানের মতো ঝুঁকিপূর্ণ যান যদি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর দিয়ে উড়ে যেতে পারে—তাহলে এর মানে রাষ্ট্র নিজেই নাগরিকের নিরাপত্তাকে হুমকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। আজ সমগ্র জাতির মুখে একই প্রশ্ন– এ দুর্ঘটনায় কি রাষ্ট্র দায় এড়াতে পারে?
শিশুদের কফিন যেন আর না দেখতে হয়- যে কোনো ধরনের বিমানের ধ্বংস থেকে! না হলে একদিন এই জাতি জেগে উঠবে বিদ্রোহে—আকাশ ছেঁড়ার জন্য, বিবেক ফেরানোর জন্য। তাই এ ধরনের বিমান যথেষ্ট ব্যবহারযোগ্য হওয়া উচিত ছিল ; যদি মেইনটেন্যান্স ও ফ্লাইট সীমাবদ্ধতা যথাযথভাবে পালন করা হতো, হয়তো এত বড় দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হতো।
এই ঘটনার দায় শুধু পাইলট বা প্রশিক্ষক প্রতিষ্ঠানের নয়। এটি রাষ্ট্রের প্রতিটি সংস্থার। সিভিল এভিয়েশন অথরিটি, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, স্থানীয় প্রশাসন—কেউই দায় এড়াতে পারে না। কেন স্কুলের ছাদে বিমান পড়লো? নিরাপত্তা ব্যবস্থা কোথায় ছিল? আগুন লাগার পর উদ্ধার কাজে কতটা প্রস্তুত ছিল ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী? আহতদের চিকিৎসায় কতটা সক্ষমতা দেখিয়েছে হাসপাতালগুলো? এসব প্রশ্নের উত্তর সরকারকে দিতে হবে। এই ঘটনা যেন আগুনে পুড়ে যাওয়া কিছু ভবনের মেরামতে আটকে না যায়। সন্তান হারানো মা-বাবার বুকফাটা আর্তনাদ কি রাষ্ট্র শুনবে?
আজ যারা কাঁদছে, আগামীকাল তারা ন্যায়বিচারের জন্য পথে নামবে। এই শোক যদি প্রতিবাদে পরিণত হয়, তাহলে রাষ্ট্রকে তাদের জবাব দিতেই হবে। কারণ যারা হারিয়েছে তারা কেবল সন্তান নয়, নিজেদের অস্তিত্ব হারিয়েছে। তাই ঘটনার পূর্ণ তদন্ত ও দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশে ঝুঁকিপূর্ণ সবধরনের কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তা নীতিমালা নতুন করে পর্যালোচনা ও প্রয়োগ করতে হবে। নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ নয়, রাষ্ট্রীয়ভাবে আজীবন সুরক্ষা দিতে হবে। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এটি একটি রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি।
শিশুদের কফিন যেন আর না দেখতে হয় যেকোনো ধরনের বিমানের ধ্বংস থেকে! না হলে একদিন এই জাতি জেগে উঠবে বিদ্রোহে—আকাশ ছেঁড়ার জন্য, বিবেক ফেরানোর জন্য। তাই এ ধরনের বিমান যথেষ্ট ব্যবহারযোগ্য হওয়া উচিত ছিল ; যদি মেইনটেন্যান্স ও ফ্লাইট সীমাবদ্ধতা যথাযথভাবে পালন করা হতো, হয়তো এত বড় দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হতো।
তাই বলতে গেলে (F‑713) বিমানটি নির্মাণ থেকে কত বছর পুরোনো ছিল তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন এবং যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণে এটি এখনো ইন এয়ারআর্থি বা নিরাপদ অবস্থায় ছিল কিনা তাও সময়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন! দুর্ঘটনার কারণ যদি বিমানের বয়স বা দুর্বলতার সাথে সম্পৃক্ত না হয়, তবে তা হয়তো অন্য কোনো কারণে: যেমন রক্ষণাবেক্ষণ ত্রুটি, অপারেশনাল চ্যালেঞ্জ বা প্রযুক্তিগত সমস্যা। কিন্তু মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজে প্রশিক্ষণ বিমানটি কোন কারণে বিধ্বস্ত হলো তা সময়ের একমাত্র প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি বিমান দুর্ঘটনার পেছনে অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে, যেগুলোকে প্রধানত চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়: মানব ত্রুটি, যান্ত্রিক ত্রুটি, আবহাওয়া এবং অন্যান্য বাহ্যিক কারণ। তাহলে এই চারটি কারণের মধ্যে ঠিক কী কারণে মাইলস্টোন কলেজে বিমানটি বিধ্বস্ত হলো?
বিমান দুর্ঘটনার সবচেয়ে সাধারণ এবং প্রধান কারণ মনুষ্যসৃষ্ট। গবেষণা অনুযায়ী, প্রায় ৭০% দুর্ঘটনা মানবসৃষ্ট ত্রুটির কারণে ঘটে থাকে। যেমন অবতরণের সময় ভুল গতি নির্বাচন, উচ্চতা নির্ধারণে সমস্যা, অভিজ্ঞতা ঘাটতি বা প্রশিক্ষণের দুর্বলতা, ক্লান্তি, স্ট্রেস বা মনোযোগ বিচ্যুতি, গ্রাউন্ড কন্ট্রোলের ভুল নির্দেশনা বা যোগাযোগ বিভ্রাটের কারণে বিমান দুর্ঘটনা হতে পারে।
এছাড়াও যান্ত্রিক ত্রুটিও ( Mechanical Failure) একটি বড় কারণ হতে পারে। কারণ বিমান যন্ত্রাংশে যে কোনো ত্রুটি গুরুতর দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। ইঞ্জিন ফেইল ( Engine Failure), হাইড্রোলিক সিস্টেম বা ল্যান্ডিং গিয়ারে ত্রুটি, অটো পাইলট সিস্টেমে গ্লিচ বা অকার্যকারিতা, দীর্ঘদিন ব্যবহারে যন্ত্রপাতির অবক্ষয়, রক্ষণাবেক্ষণের গাফিলতি বা ভুল রিপেয়ারিং প্রাকৃতিক ও আবহাওয়াজনিত কারণ (Weather Factors) ঘন কুয়াশা, বজ্রপাত বা তীব্র ঝড়, বার্ড হিট, অচেনা বায়ু প্রবাহ ( Wind Shear), টার্বুলেন্স, অপ্রত্যাশিত ঝোড়ো হাওয়া বা অবতরণের সময় বাহ্যিক প্রভাব বা নিরাপত্তা ঘাটতি ( External Causes). নাশকতা বা সন্ত্রাসী হামলা বিমান চালনার এলাকা অসুরক্ষিত বা অপরিকল্পিত স্কুল বা কলেজ কিংবা জনবহুল স্থানে উপর দিয়ে ফ্লাইট অনুমোদন বিমান যাত্রার রূপ প্লানিং এ ভুল, পর্যাপ্ত রানে বা জরুরি অবতরণ ব্যবস্থা না থাকার ফলেও বিমান দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
তাছাড়া প্রশিক্ষণ বিমানের ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু কারণ থাকে। প্রশিক্ষণ বিমানগুলোতে সাধারণত নবীন পাইলট থাকেন, তাই অতিরিক্ত কিছু ঝুঁকি থাকে: ইন্সপেক্টর ও ট্রেইনি পাইলট এর মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি, দ্রুতগতির কৌশল চর্চা করতে গিয়ে ব্যর্থতা, কম উচ্চতায় মহড়ার চেষ্টা করে নিয়ন্ত্রণ হারানো, পুরাতন ট্রেইনার মডেল বা সীমিত টেকনোলজি ব্যবহার করলেও এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে। অথবা পাইলটের ক্লান্তি বা অবসাদগ্রস্ততা, হালকা যান্ত্রিক ত্রুটি বা আবহাওয়া খারাপ — এই তিনের সম্মিলন ঘটলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
বিমান দুর্ঘটনা এড়াতে কিছু পদক্ষেপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর। এগুলো কেবল সামরিক বা বাণিজ্যিক বিমানেই নয়, প্রশিক্ষণ বিমানসহ সব ধরনের বিমান পরিচালনার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য: পাইলট ও ক্রুর প্রশিক্ষণ উন্নত করা, নিয়মিত সিমুলেশন প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক, নতুন পাইলটদের জন্য পর্যাপ্ত সুপার ভাইজড ফ্লাইট আওয়ার নিশ্চিত করা, মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য যাচাইয়ের নিয়মিত ব্যবস্থা থাকতে হবে।
নির্দিষ্ট সময় পর পর Routine Maintenance বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রতিটি ফ্লাইটের আগে ও পরে Pre-flight & Post-flight Inspection চালু করতে হবে। ওভারহোলিং ও যন্ত্রাংশ প্রতিস্থাপন যথাসময়ে সম্পন্ন করতে হবে। আধুনিক ওয়েদার রাডার ও পূর্বাভাস প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। গুরুতর আবহাওয়ার সময় ফ্লাইট বাতিল বা বিলম্বে পরিচালনার নিয়ম প্রয়োগ করতে হবে। জনবহুল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ইত্যাদির উপর দিয়ে প্রশিক্ষণ ফ্লাইট নিষিদ্ধ করতে হবে।
প্রশিক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট, নিরাপদ এলাকা ও রুট চিহ্নিত করতে হবে। বিমান চলাচল এলাকা ও আকাশপথ পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। বিমান পরিচালনার নীতিমালা কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে, আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী ফ্লাইট সেফটি প্রটোকলস ( Flight Safety Protocols) বাধ্যতামূলক করতে হবে। Civil Aviation Authority (CAA) ও সামরিক কর্তৃপক্ষের মধ্যে নিয়মিত সমন্বয় জরুরি। পুরোনো ও অনুপযুক্ত বিমান অবিলম্বে বাতিল ও প্রতিস্থাপন করা জরুরি। পাইলট এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল ( ATC) ও টেকনিক্যাল টিমের মধ্যে সঠিক ও নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ থাকা বাধ্যতামূলক। এছাড়াও Emergency response communication পদ্ধতি শক্তিশালী করা, দ্রুত উদ্ধার ও জরুরি সহায়তা প্রস্তুত রাখা জরুরি। বিমানবন্দর ও প্রশিক্ষণ এলাকার কাছে Rescue Units, Fire Teams, First Aid রাখতে হবে।
দুর্ঘটনার পর দ্রুত উদ্ধার কার্যক্রম ও চিকিৎসা দেওয়ার জন্য বিশেষ ইউনিট থাকতে হবে। এছাড়া দুর্ঘটনার সঠিক তদন্ত ও প্রকৃত সংখ্যা প্রকাশ বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রতিটি দুর্ঘটনার ‘স্বাধীন তদন্ত কমিটি’ গঠন করতে হবে। তদন্ত রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করে দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ভবিষ্যতের ঝুঁকি নিরসনে Root Cause Analysis করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
সর্বোপরি বিমান একটি জটিল প্রযুক্তি ও মানব দক্ষতার সম্মিলিত ফল। তাই প্রতিটি ধাপে সচেতনতা, প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি ব্যবহার ও দায়িত্বশীলতা অত্যাবশ্যক। দুর্ঘটনার পর রাষ্ট্রীয় শোক পালনই যথেষ্ট নয়, যে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে প্রয়োজন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার।
লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক।
এইচআর/এমএফএ/এএসএম