‘বিদেশে আমার কোনো ঠিকানা নেই, মরলে দেশের মাটিতেই মরবো’

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০২:১১ পিএম, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫

‘দেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই। দেশই হলো আমার ঠিকানা। এই দেশ, এই দেশের মাটি ও মানুষই আমার সবকিছু।’ ২০১৫ সালে লন্ডনে এক অনুষ্ঠানে কথাগুলো বলেছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।

মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) সেই চিরচেনা স্বদেশের মাটিতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনবারের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশের রাজনীতির এক আপসহীন অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটলো।

মঙ্গলবার ভোর ৬টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। দীর্ঘ সময় ধরে তিনি লিভার সিরোসিস, কিডনি জটিলতা ও হৃদরোগসহ নানা বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন।

সেই উক্তির নেপথ্যে

খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল দেশের মাটির প্রতি তার অটল টান। ২০০৭ সালের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যখন ‘মাইনাস-টু’ ফর্মুলা কার্যকর করার চেষ্টা চলছিল, তখন তাকে দেশ ছাড়ার জন্য প্রচণ্ড চাপ দেওয়া হয়। তৎকালীন সরকার তাকে সপরিবারে বিদেশে পাঠানোর সব ব্যবস্থা চূড়ান্ত করেছিল। কিন্তু তৎকালীন এই বিরোধীদলীয় নেত্রী দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন, বিদেশে আমার কোনো ঠিকানা নেই। মরলে এ দেশের মাটিতেই মরবো। জেল খেটেছেন, তবুও দেশ ছাড়েননি। আজ তার প্রয়াণের দিনে সেই অনড় অবস্থানই বারবার ফিরে আসছে নেতাকর্মীদের মুখে।

স্বদেশের টানে বারবার ফিরে আসা

দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বহুবার তাকে চিকিৎসার জন্য বা পারিবারিক কারণে বিদেশে যাওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ২০১৫ সালে লন্ডনে গিয়েও তিনি বলেছিলেন, দেশের সংকটে তার দেশে থাকা প্রয়োজন। সর্বশেষ অসুস্থ শরীর নিয়ে চলতি বছরের মে মাসে তিনি যখন বিদেশ থেকে দেশে ফেরেন, তখনো তার কণ্ঠে ছিল একই সুর। তিনি প্রমাণ করেছেন, রাজনৈতিক ক্ষমতার চেয়েও তার কাছে বড় ছিল দেশ ও মানুষের সঙ্গে নাড়ির সম্পর্ক।

রাজনীতিতে আপসহীনতা ও ত্যাগ

১৯৮১ সালে স্বামী জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার পদার্পণ ছিল কণ্টকাকীর্ণ। ১৯৮২ সালে এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে রাজপথের আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৯১ সালে দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়া সবখানেই তার মূল শক্তি ছিল জনগণের আস্থা। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশ না নিয়ে তিনি ‘আপসহীন’ নেত্রীর তকমা পেয়েছিলেন। এরপর ১/১১-এর দুঃসময় কিংবা ২০১৮ সালের কারাবাস, কোনো কিছুতেই তাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা যায়নি।

গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মুক্তি পান খালেদা জিয়া। ৭ আগস্ট রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির এক সমাবেশে খালেদা জিয়া একটি সংক্ষিপ্ত ভিডিও বক্তব্য দেন। গণ-অভ্যুত্থানে তরুণদের স্বপ্নের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আসুন, ধ্বংস নয়, প্রতিশোধ নয়, প্রতিহিংসা নয়; ভালোবাসা, শান্তি ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলি।’

এক নিঃসঙ্গ সংগ্রাম

জীবনের শেষ কয়েক বছর খালেদা জিয়া কাটিয়েছেন চরম একাকিত্ব আর অসুস্থতার মধ্যে। এক ছেলের মৃত্যু আর অন্য ছেলের নির্বাসন তাকে মানসিকভাবে ব্যথিত করলেও রাজনৈতিকভাবে তিনি ছিলেন অবিচল। আজ তার মৃত্যুর পর দলীয় সমর্থকরা বলছেন, তিনি যা বলতেন, তা কাজে করে দেখিয়েছেন। তিনি বিদেশে আয়েশি জীবন বেছে নিতে পারতেন, কিন্তু তিনি বেছে নিয়েছেন স্বদেশের ধুলোমাটি আর জীর্ণ কারাগার।

আজ থেকে খালেদা জিয়া আর নেই, কিন্তু তার সেই কালজয়ী উক্তি, ‘দেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই’ হয়ে রইলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।

টিটি/এসএনআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।