এরশাদ থেকে হাসিনার আমল, খালেদা জিয়ার কারাজীবন

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০২:৪৪ পিএম, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫

রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্মম দমন-পীড়ন, অপমান ও অব্যাহত অবহেলার বিপরীতে একা দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি, একজন নারী। স্বামীর মৃত্যুজনিত শোক আর সন্তানের শূন্যতা হৃদয়ে ধারণ করেও তিনি পিছু হটেননি। চারদিক থেকে ঘিরে ধরা ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে সামনে এগিয়ে গেছেন অবিচল দৃঢ়তায়। তার নাম বেগম খালেদা জিয়া।

বিএনপি চেয়ারপারসন ও ৩ বারের প্রধানমন্ত্রীর পথচলা ছিল দীর্ঘ, কষ্টকর ও অসহ্য যন্ত্রণায় ভরা। কখনো ক্লান্তি তাকে ছুঁয়েছে, কখনো নিঃসঙ্গতা ভার হয়ে নেমেছে, তবু বেগম খালেদা জিয়া থেমে যাননি। আপস করেননি অন্যায়ের সঙ্গে। হার মানেননি সময়ের নিষ্ঠুরতায়।

কারণ তিনি জানতেন এই লড়াই শুধু তার ব্যক্তিগত নয়, এটি ন্যায়, গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার রক্ষার সংগ্রাম। আর সেই বিশ্বাসই তাকে বারবার দাঁড় করিয়েছে, আরও দৃঢ়, আরও অবিচল করে।

এরশাদ থেকে শেখ হাসিনা, ভিন্ন শাসনামলে খালেদা জিয়ার কারাজীবন বাংলাদেশের রাজনীতির এক দীর্ঘ ও নাটকীয় অধ্যায়।স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে নির্বাচনি সংকট, জরুরি অবস্থা এবং কথিত দুর্নীতি মামলার ধারাবাহিকতায় একাধিকবার গ্রেফতার ও কারাবরণ করতে হয়েছে খালেদা জিয়াকে। প্রতিটি শাসনামলেই ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে হলেও কারাবাস হয়ে ওঠে তার রাজনৈতিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা দেশের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, বিরোধী রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় আচরণের প্রতিফলন বহন করে।

বেগম খালেদা জিয়াকে মোট পাঁচবার গ্রেফতার ও কারাবরণ করতে হয়েছে, যা বাংলাদেশের অস্থির রাজনৈতিক ইতিহাস এবং বিরোধী আন্দোলন ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বে তার কেন্দ্রীয় ভূমিকার প্রতিফলন।

এরশাদবিরোধী আন্দোলনে গ্রেফতার

১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে যোগদানের পর খালেদা জিয়া স্বৈরশাসক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা হয়ে ওঠেন। এই সময়ে তিনি আন্দোলন ও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিতে গিয়ে তিনবার গ্রেফতার হন, ১৯৮৩ সালের ২৮ নভেম্বর, ১৯৮৪ সালের ৩ মে এবং ১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর।

তবে এসব কারাবাস তুলনামূলকভাবে স্বল্পমেয়াদি ছিল এবং এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় তাকে দীর্ঘমেয়াদি সাজা ভোগ করতে হয়নি।

২০০৭ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আটক

২০০৬ সালে তার সরকারের মেয়াদ শেষে দেশ একটি গভীর রাজনৈতিক সংকটে পড়ে। সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে এবং জাতীয় নির্বাচন স্থগিত হয়। খালেদা জিয়া ও তার পরিবারের ওপর বড় ঝড় আসে ২০০৭ সালের এক-এগারোর পর। সে সময় সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার জরুরি অবস্থা জারি করে। খালেদা জিয়া, তার বড় ছেলে তারেক রহমান, ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোকে গ্রেফতার করা হয়। সে সময় বিএনপিকে ভাঙার, খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার নানা চেষ্টা করা হয়। ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট এলাকার মইনুল হক রোডের বাসভবন থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।

চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করার পর তার জামিন আবেদন নাকচ করা হয় এবং তাকে জাতীয় সংসদ ভবন কমপ্লেক্সে স্থাপিত বিশেষ সাব-জেলে পাঠানো হয়।

আটক অবস্থায় খালেদা জিয়া ২০০৭ সালের ১৪ অক্টোবর ঈদুল ফিতর এবং একই বছরের ২১ ডিসেম্বর ঈদুল আজহা কারাগারেই পালন করেন।

২০০৮ সালের ১৮ জানুয়ারি দিনাজপুরে তার মায়ের মৃত্যু হলে, পরদিন ছয় ঘণ্টার জন্য প্যারোলে মুক্তি দিয়ে তাকে জানাজায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়।

মোট ৩৭২ দিন কারাভোগের পর ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তিনি জামিনে মুক্তি পান।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময় কারাবাস

২০১৮ সালে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময় খালেদা জিয়াকে আবার কারাবরণ করতে হয়। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় তাকে মোট ১৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তাকে গ্রেফতার করে পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়।

স্বাস্থ্যগত অবস্থার অবনতি হলে পরে তাকে চিকিৎসার জন্য তৎকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।

তিনি কার্যত দুই বছরেরও বেশি সময় বন্দি অবস্থায় ছিলেন। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকার শর্তসাপেক্ষে তার সাজা স্থগিত করে, যাতে তিনি বাসায় থেকে চিকিৎসা নিতে পারেন। তবে এটি পূর্ণ মুক্তি ছিল না, তিনি কার্যত গৃহবন্দির মতো আইনগত সীমাবদ্ধতার মধ্যে ছিলেন।

২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলনের পর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পরিবর্তন এলে, রাষ্ট্রপতির নির্বাহী আদেশে তার সাজা লঘু হয়। ২০২৪ সালের ২৭ নভেম্বর দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়া খালাস পান।

সব সময় উদার রাজনীতির ধারা বজায় রেখেছিলেন খালেদা জিয়া। আজ মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) সকাল ৬টায় মারা যান এই রাজনীতিবিদ। তার মৃত্যুতে শোক বইছে দেশজুড়ে।

টিটি/এসএনআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।