দীর্ঘ অসুস্থতা-রাজনৈতিক সংগ্রামের অবসান খালেদার
দীর্ঘ সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবনে একাধিকবার গুরুতর অসুস্থতার মধ্য দিয়ে যাওয়ার পর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। আজ মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) ভোর ৬টায় ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) তিনি। বিজয়ের মাসে তার মৃত্যুতে রাজনৈতিক অঙ্গনে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাগারে পাঠানো হয় খালেদা জিয়াকে। এরপর অসুস্থ অবস্থায় ওই বছরের ৬ অক্টোবর তাকে কারাগার থেকে পিজি হাসপাতালে নেওয়া হয়। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে সেখান থেকে বাসায় ফেরেন তিনি।
২০২১ সালের ১১ এপ্রিল খালেদা জিয়ার কোভিড-১৯ রিপোর্ট পজিটিভ আসে। একই মাসের ১৫ এপ্রিল এভারকেয়ার হাসপাতালে সিটি স্ক্যান করা হয় এবং ২৭ এপ্রিল কোভিড চিকিৎসার জন্য প্রথমবারের মতো এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। ওই বছর ১৯ জুলাই তিনি কোভিড টিকার প্রথম ডোজ নেন, দ্বিতীয় ডোজ ১৮ আগস্ট এবং তৃতীয় ডোজ নেন ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি।
২০২১ সালের ২৫ অক্টোবর তার প্রথম অপারেশন হয়। এরপর ২০২২ সালের ১১ জুন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মধ্যরাতে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন খালেদা জিয়া। ২৪ জুন বিকেল ৫টায় হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরেন তিনি। একই বছরের ২২ আগস্ট নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে যান এবং ২৮ আগস্ট আবার ভর্তি হন। পরবর্তীতে ৩১ আগস্ট বাসায় ফেরেন তিনি।
২০২৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে যান খালেদা জিয়া। পরে আবার অসুস্থতাজনিত কারণে ২৯ এপ্রিল হাসপাতালে ভর্তি হন। ৪ মে বাসায় ফেরেন। ওই বছরের ১৩ জুন রাত দেড়টায় আবার হাসপাতালে ভর্তি হন বিএনপি চেয়ারপারসন। ৯ আগস্ট ফের হাসপাতালে ভর্তি হন।
খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য ওই বছরের ২৫ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের তিনজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ঢাকায় আসেন এবং ২৬ অক্টোবর তারা চেয়ারপারসনের অস্ত্রোপচার করেন। ২৮ অক্টোবর চিকিৎসকরা ঢাকা ত্যাগ করেন। দীর্ঘ পাঁচ মাস দুই দিন পর ১১ জানুয়ারি বিকেল ৫টায় তিনি হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরেন।
২০২৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে যান খালেদা জিয়া। পরবর্তীতে আবার অসুস্থ হলে ৩১ মার্চ ভর্তি হয়ে ২ এপ্রিল বাসায় ফেরেন তিনি। ১ মে আবার স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে গিয়ে ২ মে বাসায় ফেরেন। ওই বছরের ২২ জুন রাত ৩টায় হসপাতালে ভর্তি হয়ে ২ জুলাই সন্ধ্যা ৬টায় বাসায় ফেরেন।
বিএনপি চেয়ারপারসন তার অসুস্থতার কারণে আবারও ৮ জুলাই ভোর ৪টা ২০ মিনিটে বাসা থেকে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন এবং ২১ আগস্ট বাসায় ফেরেন। একই বছরের ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতির নির্বাহী আদেশে তিনি মুক্তি পান।
২০২৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর রাত ১টা ৩০ মিনিটে আবার হাসপাতালে যান খালেদা জিয়া। উন্নত চিকিৎসার জন্য ২০২৫ সালের ৭ জানুয়ারি তিনি লন্ডনের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়েন এবং ৫ মে চিকিৎসা শেষে ঢাকার পথে রওয়ানা হন। এরপর ১৯ জুন, ২৪ জুলাই (মধ্যরাতে), ২৮ আগস্ট এবং ১৫ অক্টোবর রাতে তিনি এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। সবশেষ চলতি বছরের ২৩ নভেম্বর রাতে তাকে পুনরায় এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
রাজনৈতিক কর্মসূচির ক্ষেত্রেও দীর্ঘদিন তিনি সরাসরি সক্রিয় থাকতে পারেননি। ২০২১ সালের ২৩ নভেম্বর খালেদা জিয়ার বিদেশে উন্নত চিকিৎসা ও মুক্তির দাবিতে বিএনপি ৮ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। এরপর ২০২৩ সালের ১৪ অক্টোবর সারাদেশে অনশন কর্মসূচি পালিত হয়। ২০২৪ সালের ২৯ জুন নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশসহ তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
বেগম খালেদা জিয়ার সবশেষ বড় সমাবেশ ছিল ২০১৭ সালের ১২ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ উপলক্ষে। এর আগে ২০১০ সালের ৭ নভেম্বর নয়াপল্টনে বিপ্লব ও সংহতি দিবসের সমাবেশ হয়। সবশেষ তার উপস্থিতিতে ইফতার ও ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠান হয় ২০১৬ সালে বসুন্ধরা কনভেনশন হলে।
তার স্বামী শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজারে খালেদা জিয়া সবশেষ জিয়ারত করেন ২০১৮ সালে। চেয়ারপারসনের উপস্থিতিতে বিএনপির সংবাদ সম্মেলন, নির্বাহী কমিটি, স্থায়ী কমিটি ও ২০ দলীয় জোটের সবশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয় ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে। একই মাসে সড়কপথে ঢাকার বাইরে তার সর্বশেষ যাত্রা ছিল সিলেটে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১ সালের ২ জুলাই ঢাকার সিদ্ধেশ্বরীর এক আত্মীয়ের বাসা থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে প্রথমবারের মতো গ্রেফতার হন খালেদা জিয়া। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে টানা প্রায় সাত বছর তিনি কারাভোগ করেন। শেষ পর্যন্ত ২০২৪ সালের ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতির আদেশে মুক্তি পান।
গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার সংগ্রামে আপসহীন ভূমিকার জন্য পরিচিত এই নেত্রীর মৃত্যুতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি সোনালী অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হলো।
কেএইচ/এএমএ/জেআইএম