চরম সংকটেও অটল খালেদা জিয়ার ‘সংগ্রামী জীবন’
বেগম খালেদা জিয়ার জন্ম নাম খালেদা খানম পুতুল। ১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট ব্রিটিশ ভারতের বঙ্গ প্রদেশের জলপাইগুড়িতে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬০ সালে তিনি জিয়াউর রহমানকে বিয়ে করেন। ১৯৭৭ সালে তার স্বামী রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর খালেদা জিয়া বাংলাদেশের ফার্স্ট লেডি হিসেবে জাতীয়ভাবে পরিচিত হন। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান হত্যার শিকার হলে খালেদা জিয়া রাজনীতিতে যোগ দেন এবং বিএনপির নেতৃত্বে আসেন।
বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি চেয়ারপারসন। তিনি ১৯৯১ সাল থেকে তিনবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী এবং মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় নির্বাচিত নারী সরকার প্রধান।
১৯৮১ সালের ব্যর্থ অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি জিয়ার শাহাদতবরণের পর, তিনি ১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি সাধারণ সদস্য হিসেবে বিএনপিতে যোগ দেন। বেগম জিয়া ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে দলের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং ১৯৮৪ সালের আগস্টে দলের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।

১৯৮২ সালে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের পর, খালেদা জিয়া গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য সর্বাত্মক আন্দোলনের সূচনা করেন। তিনি এরশাদের স্বৈরাচারের অবসান ঘটাতে ১৯৮৩ সালে গঠিত সাতদলীয় জোট গঠনের স্থপতি ছিলেন।
খালেদা জিয়া ১৯৮৬ সালের কারচুপির নির্বাচনের বিরোধিতা করেন এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। যদিও আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) মতো রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা এরশাদের অবৈধ সরকারকে বৈধতা দেওয়ার জন্য জাতীয় পার্টির নেতৃত্বাধীন শাসনের অধীনে নির্বাচনে যোগ দিয়েছিল। খালেদা জিয়ার দৃঢ় সংকল্পের কারণে তাকে ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সাতবার আটক করা হয়েছিল।
খালেদা জিয়া বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলকে শক্তিশালী একটি সংগঠনে পরিণত করেন। ফলে তারা সারাদেশে ৩২১টি ছাত্র সংসদগুলোর মধ্যে ২৭০টি জয়লাভ করে। এই ছাত্ররা এরশাদের শাসনের পতনের আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯৮০ দশকে এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কঠোর বিরোধিতা এবং বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে ভূমিকা রাখার কারণে তিনি ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি একটি অবাধ ও সুষ্ঠু সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন বেগম জিয়া। তার প্রধানমন্ত্রিত্বকালে দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রে পরিণত হয়। দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার মেয়াদে কিছু বড় অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। কর্মসংস্থানের হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় এই সময় এবং শুধু তৈরি পোশাকশিল্প খাতেই পাঁচ বছরে কর্মসংস্থানের বৃদ্ধি ছিল ২৯ শতাংশ। প্রায় দুই লাখ নারী এই সময় তৈরি পোশাকশিল্প খাতে যোগ দেন।
খালেদা জিয়া জাতিসংঘে গঙ্গার পানি-বণ্টনের সমস্যা উত্থাপন করেন, যাতে বাংলাদেশ গঙ্গার পানির ন্যায্য অংশ পায়। ১৯৯২ সালে তাকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানানো হলে সেখানে তিনি রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীদের সমস্যা উত্থাপন করেন এবং পরে মিয়ানমার সরকার ১৯৯০ দশকের প্রথম দিকে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে একটি চুক্তি করে।
১৯৯৬ সালে বিএনপির নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর খালেদা জিয়া টানা দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং পুনরায় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রতিশ্রুতির কারণে, তিনি এক মাসের মধ্যে পদত্যাগ করেন। যদিও বিএনপি ১৯৯৬ সালের জুনের নতুন নির্বাচনে হেরে যায়, দলটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সংসদে সবচেয়ে বড় বিরোধী দল হিসেবে ১১৬টি আসন পায় সেই নির্বাচনে।

১৯৯৯ সালে বেগম জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ঐক্যজোটের সঙ্গে চারদলীয় জোট গঠন করে এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি আন্দোলন কর্মসূচি শুরু করে। বেগম খালেদা জিয়া দুর্নীতি ও সন্ত্রাস নির্মূলের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়ী হন। ফোর্বস ম্যাগাজিন নারী শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নে তার ভূমিকার জন্য ২০০৫ সালে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারীদের তালিকায় তাকে ২৯ নম্বরে স্থান দেয়।
২০০৬ সালে খালেদা জিয়া একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে তাকে ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্বাসনে পাঠানোর একাধিক প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে দুর্নীতির তুচ্ছ এবং ভিত্তিহীন অভিযোগে স্বৈরাচারী সরকার গ্রেফতার করে।
ক্ষমতায় থাকাকালীন, খালেদা জিয়ার সরকার বাধ্যতামূলক বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা, মেয়েদের জন্য দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষা, ছাত্রীদের জন্য একটি শিক্ষা ‘উপবৃত্তি’ এবং শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য খাদ্য প্রবর্তন করে শিক্ষা ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি করেছিল। তার সরকার সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ২৭ বছর থেকে বাড়িয়ে ৩০ বছর করে এবং শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ করে।
বেগম জিয়া কোনো আসনেই পরাজিত না হওয়ার অনন্য রেকর্ডের অধিকারী। ১৯৯৬ সালের জুনে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেবার সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। তবে সেই নির্বাচনেও খালেদা জিয়াকে হারাতে পারেননি কেউ। পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সব কটিতে বিজয়ী হন তিনি। আসনগুলো হলো বগুড়া–৬, বগুড়া–৭, ফেনী–১, লক্ষ্মীপুর–২ ও চট্টগ্রাম–১।

পরবর্তী সময়ে ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনেও খালেদা জিয়া বগুড়া–৬, বগুড়া–৭, খুলনা–২, ফেনী–১ ও লক্ষ্মীপুর–২—এই পাঁচ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সব কটি আসনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছিলেন। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে খালেদা জিয়া তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন।
২০০৯ সাল থেকে, যখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার বাংলাদেশকে একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত করে, তখন তিনি গণতন্ত্রের জন্য তার লড়াই নতুন করে শুরু করেছিলেন। সরকার তাকে জোরপূর্বক তার বাড়ি থেকে বের করে দেয় এবং গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন শুরু করায় তাকে দুইবার গৃহবন্দী করে। গণতন্ত্রের প্রতি তার ভূমিকার জন্য তাকে ২০১১ সালে নিউ জার্সির স্টেট সিনেট ‘গণতন্ত্রের জন্য যোদ্ধা’ উপাধিতে সম্মানিত করে।
খালেদা জিয়া ও তার পরিবারের ওপর বড় ঝড় আসে ২০০৭ সালের এক-এগারোর পর। সে সময় সেনা–সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার জরুরি অবস্থা জারি করে। খালেদা জিয়া, তার বড় ছেলে তারেক রহমান, ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোকে গ্রেফতার করা হয়। সে সময় বিএনপিকে ভাঙার, খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার নানা চেষ্টা করা হয়।
এমন একটি পটভূমিতে ২০০৭ সালে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে কানাঘুষা শোনা যাচ্ছিল যে খালেদা জিয়া দেশত্যাগ করবেন, সৌদি আরবে যাবেন। এর আগে ৮ মার্চ তারেক রহমান গ্রেফতার হওয়ার পর তিনি মুষড়ে পড়েন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের অনেকে গা ঢাকা দেন। ২২ এপ্রিল রাতে বিএনপির তৎকালীন কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক মন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার আ স ম হান্নান শাহ সাংবাদিকদের মাধ্যমে জানিয়ে দেন যে খালেদা জিয়া সৌদি আরবে যাবেন না। তিনি যেকোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে প্রস্তুত, তবু দেশ ছাড়বেন না।
পরে খালেদা জিয়া নিজেই বলেন, ‘দেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নাই, এটাই (বাংলাদেশ) আমার ঠিকানা। এই দেশ, এই দেশের মাটি-মানুষই আমার সবকিছু। কাজেই আমি দেশের বাইরে যাব না।’

সেনা–সমর্থিত এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ৭ মার্চ একটি দুর্নীতির মামলায় তারেক রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। ৩ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার হন আরাফাত রহমান কোকো। একই দিন গ্রেফতার করা হয় খালেদা জিয়াকে। পরে তারেক রহমানকে লন্ডনে আর আরাফাত রহমানকে চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ডে পাঠানো হয়। কারাগারে থাকাকালে খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর চেষ্টা করা হলেও তিনি রাজি হননি।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। ওই বাড়িতে তিনি ২৮ বছর ধরে বসবাস করছিলেন। খালেদা জিয়া ওঠেন গুলশানের ভাড়া বাসা ফিরোজায়। ২০১৩ সালে তুমুল আন্দোলন দানা বাঁধলে এই বাসার সামনে রাস্তার ওপরে ব্যারিকেড দিয়ে তাকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর ২০১৫ সালে আবার আন্দোলন দানা বাঁধলে খালেদা জিয়াকে গুলশানের কার্যালয়ের সামনের সড়কে ১৪টি ট্রাক ও ভ্যান দিয়ে আটকে রাখা হয়েছিল।
এই ঘটনাগুলো খালেদা জিয়ার জীবনে এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। এর মধ্যে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে মালয়েশিয়ায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান মারা যান। তখন খালেদা জিয়া তার গুলশানের কার্যালয়ে অবরুদ্ধ।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ২০১৮ সালে বেগম খালেদা জিয়াকে ১৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২০২০ সালের কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিস প্রতিবেদনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় আইন বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিল যে, মূলত নির্বাচনি প্রক্রিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য একটি রাজনৈতিক চক্রান্ত হিসেবেই তাকে সাজা দেওয়া হয়েছিল। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যে তার ‘ন্যায্য বিচারের অধিকারকে সম্মান করা হয়নি।’
গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মুক্তি পান খালেদা জিয়া। ৭ আগস্ট রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির এক সমাবেশে খালেদা জিয়া একটি সংক্ষিপ্ত ভিডিও বক্তব্য দেন। গণ-অভ্যুত্থানে তরুণদের স্বপ্নের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আসুন, ধ্বংস নয়, প্রতিশোধ নয়, প্রতিহিংসা নয়; ভালোবাসা, শান্তি ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলি।’
টিটি/এমএমএআর/এমএস