কাঁটায় ভরা রাজনীতিতে সুবাস ছড়ানো খালেদা জিয়া
একজন সাধারণ নারী, একজন গৃহবধূ, একজন মা এতসব পরিচয় ছাপিয়ে একজন দক্ষ দেশ পরিচালকের চিরবিদায় আজ। বিএনপি চেয়ারপারসন ও তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া মারা গেলেন কুয়াশায় মোড়ানো এক সকালে।
আজ বুধবার (৩১ ডিসেম্বর) রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে লাখ লাখ মানুষের অংশগ্রহণে জানাজা শেষে খালেদা জিয়ার দাফন সম্পন্ন হবে। স্বামী প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পাশেই শায়িত হবেন তিনি। খালেদা জিয়ার এমন মৃত্যুযাত্রা হয়তো কেউ ভাবতে পারেনি। এ যেন রাজকীয়ভাবে দেশবাসীর কাছ থেকে বিদায় নেওয়া, এমন ভাগ্য কজন রাজনীতিবিদের ভাগ্যে জোটে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের নানা রকম সংকট চোখে দেখেছেন খালেদা জিয়া। ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। হয়তো ভাবেননি স্বামীর মৃত্যুর পর রাজনীতির পথে হাঁটতে হবে তাকে। অনেকটা অনিচ্ছুকই ছিলেন রাজনীতিতে আসতে। কিন্তু কী বিধি, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর দল ও দেশের হাল ধরতে হয় তাকে। দেশের মানুষের সেবা করার সুযোগ পেয়েছিলেন তিন তিনবার।
বাংলাদেশের রাজনীতির পথ কঠিন এবং বন্ধুর। সেই পথ বেছে নিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। দিনাজপুরের মেয়ে পুতুল রাজনীতির ময়দানে হয়ে ওঠেন একজন দক্ষ পরিচালক। রাজনীতির খোলামেলা আলোচনায় অনেকে বলেন, মিষ্টভাসী, স্পষ্টবাদী, সৎ সাহসী, গণতন্ত্রকে আঁকড়ে ধরা একজন দক্ষ, সহনশীল রাজনীতিবিদ ছিলেন খালেদা জিয়া।
রাজনীতির ব্যস্ততার মধ্যেও পরিবার-পরিজন আর স্বজনদের খোঁজ রেখেছেন। তার মৃত্যুতে অঝোরে কাঁদছে বগুড়া, ফেনী, দিনাজপুরসহ সারা দেশের মানুষ।
ছেলে তারেক রহমানকেও একজন দক্ষ রাজনীতিবিদ হিসেবে তৈরি করে রেখে গেলেন খালেদা জিয়া। ৪১ বছর ধরে বিএনপির চেয়ারপারসনের গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশকে একটি দক্ষ, শক্তিশালী রাজনৈতিক দল উপহার দিয়ে গেলেন খালেদা জিয়া। জুলাই আন্দোলনে ছাত্র-জনতার কাতারে এসে আন্দোলন করেছে বিএনপি।
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর জুলাই আন্দোলনকারীদের সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল খালেদা জিয়াকে দেখে মনে হয়েছে এমন দেশনেত্রীই তো দরকার আমাদের।
সবশেষ তার অনলাইন বক্তব্যে খালেদা জিয়া দেশবাসীকে ঐক্য ধরে রেখে নিরাপত্তা আর দেশবাসীর শান্তি ও কল্যাণের জন্য কাজ করার আহ্বান জানিয়ে গেছেন।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিগত ১৭ বছর ধরে নানাভাবে সমালোচনা করেছিলেন খালেদা জিয়ার। কিন্তু তার জবাবে পাল্টা আক্রমণ করেননি খালেদা জিয়া। তার মৃত্যু নিয়েও কটাক্ষ করেন শেখ হাসিনা। কিন্তু নীরব থেকেছেন তিনি। তার এই শালীনতা আর সহনশীল মনোভাব দেশবাসীর নজর কাড়ে।
স্বামী প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত সেনানিবাসের শহীদ মইনুল রোডের ৬ নম্বর বাড়ি থেকে খালেদা জিয়াকে বের করে দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। সেদিন কষ্টে কেঁদেছিলেন খালেদা জিয়া, টেলিভিশনের পর্দায় তার সেই ভিডিও দেখে কেঁদেছিলেন হাজারো মানুষ। খালেদা জিয়া সেদিন বলেছিলেন দেশবাসীই এর বিচার করবে।
বারবার দেশের মাটিকে আঁকড়ে ধরে রাখার কথা বলেছিলেন খালেদা জিয়া। বলেছিলেন, দেশের মানুষই আমার সব। মানুষের কল্যাণে স্বামীর রেখে যাওয়া কাজ ভালোভাবেই করার আপ্রাণ চেষ্টা ছিল তার।
বাংলাদেশের নারীরা যাতে শিক্ষা-দীক্ষায় দক্ষ হয়ে উঠতে পারে সেকারণে চালু করেছিলেন উপবৃত্তি। নারী শিক্ষার প্রসারে তার অবদান অগণিত। দেশের অর্থনীতিকেও এগিয়ে নিয়ে গেছেন বহুদূর।
শিফন শাড়ি পরা আর মাথায় ঘোমটা দেওয়া ভদ্র এক নারীর ছবি টিভি পর্দায় বারবার ভেসে উঠলেও বলার অপেক্ষা নেই, বাংলাদেশের মতো একটি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে দৃঢ় প্রত্যয়, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সুস্থ রাজনীতির ধারার যে আদর্শ, শক্তিশালী রাজনৈতিক দল গঠনের যে মানসিকতা, পররাষ্ট্রনীতিতে দেশকে এগিয়ে রাখার মতো সৎ সাহস সব গুনই ছিল খালেদা জিয়ার। যখনই একজন দক্ষ রাজনীতিবিদ, দেশপ্রেমিক, রাষ্ট্রনায়ক আর দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করা নিয়ে কারও প্রশ্ন আসে তখনই সবার আগে স্মৃতিতে ভাসে খালেদা জিয়ার নাম। খালেদা জিয়া যেন কাঁটায় ভরা রাজনীতিতে সুবাস ছড়ানো গোলাপ।
এসএনআর/এমএমএআর/এএসএম